আবুল আব্বাস আস সাফফাহ এর পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত্ব ।
Introduction, Character and Achievements of Abul Abbas As-Saffah
পরিচয়:
আব্বাসি বংশের প্রথম শাসক আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ ছিলেন মহানবি (স)-এর চাচা আল আব্বাসের বংশধর। তার পিতার নাম মুহম্মদ বিন আলী। ইব্রাহীম এবং আবু জাফর আল মনসুর ছিলেন তার ভাই। আব্বাসি আন্দোলনের মাধ্যমে ৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ নভেম্বর ইরাকের কুফা মসজিদে আবু মুসলিম তাকে খলিফা ঘােষণা করেন। পরে আবু মুসলিম ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় মারওয়ানকে পরাজিত করলে উমাইয়া বংশের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট মারওয়ানের ছিন্ন মস্তক দেখে আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ’ বা ‘রক্তপিপাসু’ উপাধি গ্রহণ করেন। আব্বাসি খিলাফতের এই প্রতিষ্ঠাতা ৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
চরিত্র
নিষ্ঠুরতা: আবুল আব্বাস আস-সাফফার কর্মকাণ্ডে নিষ্ঠুরতার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। আবুল আব্বাস শুধু নিষ্ঠুরই ছিলেন না, অঙ্গীকারের বরখেলাপকারী; এমনকি বিশ্বাসঘাতকও ছিলেন। তবে ঐতিহাসিক উইল-এর এই মন্তব্যকে অস্বীকার না করেও বলা যায়, মধ্যযুগীয় রাজাদের মধ্যে এরূপ চরিত্র অস্বাভাবিক ছিল না। ঐতিহাসিক পি কে হিটি সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখ তার বিশ্বাসঘাতকতাকে মধ্যযুগীয় প্রেক্ষাপট থেকেই বিবেচনা করেছেন। সৈয়দ আমীর আলী বলেন- “মধ্যযুগীয় রাজাদের কাছে নরহত্যা আদৌ ন্যক্কারজনক বলে বিবেচিত হতাে না।”
উমাইয়া বংশীয়দের নির্মমভাবে নিধন: খিলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আস-সাফফাহর প্রধান লক্ষ্য ছিল উমাইয়া বংশীয়দের নিমূল করা। তিনি ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুন ফিলিস্তিনের আবু ফুত্রসে ৮০ জন উমাইয়া বংশের লােককে সমঝােতার নামে ভােজের আমন্ত্রণ করে ডেকে এনে সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। বসরাতেও অনুরূপভাবে হত্যাযজ্ঞ সাধিত হয়। শুধু তাই নয়, আস সাফফাহর আদেশে মৃতদের কবর থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাড়গুলাে ভস্মীভূত করে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মুয়াবিয়া এবং দ্বিতীয় উমর ছাড়া সকল উমাইয়া খলিফার সমাধি ধ্বংস করা হয়।
চারিত্রিক দৃঢ়তা: সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “সকল নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও সাফফাহকে সদাশয়, কর্তব্যপরায়ণ এবং ভােগাসক্তিবিহীন নরপতি বলে মনে করা হতাে।” সে যুগে সমাজে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করার প্রথা বিদ্যমান থাকলেও আস সাফফাহর সালমা নামক একজনমাত্র স্ত্রী ছিল। পি কে হিট্টি বলেন, “আস সাফফাহ আরবে ইসলামের সর্বাপেক্ষা গৌরবােজ্জ্বল এবং দীর্ঘতম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রজাদরদী, বিদ্যোৎসাহী, কর্তব্যপরায়ণ ও চরিত্রবান হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন।
জনকল্যাণকামী: আস-সাফফাহ একজন প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। তিনি কুফা থেকে মক্কা পর্যন্ত দীর্ঘ মহাসড়ক নির্মাণ করেন। এছাড়া হজযাত্রীদের সুবিধার জন্য রাস্তার ধারে দূরত্ব নির্দেশক মাইলফলক স্থাপন ও সরাইখানা নির্মাণ করেন।
শিল্প-সাহিত্যানুরাগী: আস-সাফফাহ শিল্প ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। তিনি জ্ঞানী-গুণী ও কবি-সাহিত্যিকদের সমাদর করতেন। তার খিলাফতে ইমাম আবু হানিফা প্রথম ফিকাহশাস্ত্রের চর্চা শুরু করেন।
কৃতিত্ব
বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ ও দমন: উমাইয়া ও বিদ্রোহী মনোভাবাপন্নদের আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ সফলভাবে দমন করেন। তবে এজন্য তিনি নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেকের মনে ক্ষমতাচ্যুত উমাইয়াদের প্রতি সহমর্মিতা ছিল। উমাইয়া রাজবংশের সমর্থকরা দামেস্ক , হিমস, কিন্নিসিরিন, ফিলিস্তিন এবং মেসোপটেমিয়ায় সাফফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। ইরাকে উমাইয়া রাজপ্রতিনিধি ইয়াজিদ ইবনে হুবাইয়া ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন। তখন আস-সাফফাহ সেনাপতি হাসান-ইবন-কাহতাবা এবং ভাই আৰু জাফরকে পাঠিয়ে তাকে হত্যা করান।
প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস : প্রাথামিক বাধা-বিপত্তি এবং বিদ্রোহের মূলােৎপাটনের পর আস সাফফাহ প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা পূনর্গঠন করেন। বিভিন্ন প্রদেশে শাসনকর্তা নিয়ােগের ব্যাপারে তিনি বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করেন। আস-সাফফাহ নিজের পিরবারের সদস্য কিংবা যে সকল লােক তার বংশের শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাদের ঐ সব পদের দায়িত্ব দেন। খালিদ ইবনে বার্মাককে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় । আস-সাফফাহকে খলিফা বলে ঘােষণা করতে বিশেষভাবে সহায়তাকারী আবু সালামা খাল্লালকে নিযুক্ত করা হয় উজির পদে। আব্বাসি খিলাফতের কাঠামােকে সুসংহত করার জন্য আস-সাফফাহর তার ভাই ও উত্তরাধিকারী আবু জাফরকে ইরাক, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি পিতৃব্য দাউদ ইবনে আলীকে হেজাজের ও আব্দুল্লাহ ইবনে আলীকে সিরিয়ার শাসনকর্তার পদ প্রদান করেন। সুলাইমান ইবনে আলী নামে অন্য একজন পিতৃব্যকে বসরা ও এর অধীনস্থ অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন। তখতবখশ (Kingmaker) আবু মুসলিমকে খােরাসানের এবং সেনাপতি আৰু আয়ুনকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
নতুন রাজধানী স্থাপন: খলিফা আস-সাফফাহ তার নিজের ও বংশের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কুফা থেকে আল হাশেমিয়াতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সেখানে ‘আল হাশেমিয়া নামে একটি দুর্গ প্রাসাদও নির্মাণ করেন তিনি।
শাসনকালের নিন্দিত ঘটনা: আবু সালামা খাল্লালের হত্যাকাণ্ড আস-সাফফাহর শাসনকালের একটি চরম নিন্দিত ঘটনা । আবু মুসলিম একসময় আবু সালামার, প্রতিপত্তি. ও পদমর্যাদায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। আবু সালামা খাল্লাল একদিন রাতে খলিফার প্রাসাদ থেকে ফেরার সময় আবু মুসলিমের নিয়ােজিত দুবৃত্ত দল তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যার অপবাদ খারেজিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকারী মনােনয়ন: আবুল আব্বাস আস-সাফাহ প্রায় সাড়ে চার বছর রাজত্ব করার পর বসন্ত রােগে আক্রান্ত হয়ে ৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে মৃত্যু বরণ করেন। হিরার অনতিদূরে আম্বর নামক স্থানে তার মৃত্যু হয়। আস-সাফফাহ মৃত্যুকালে মুহাম্মদ নামে এক পুত্র এবং রাইতা নামে এক কন্যা রেখে যান। রাইতার সাথে পরবর্তীকালে তার পিতৃব্যপুত্র মুহাম্মদ আল মাহদীর বিবাহ হয়। মৃত্যুর আগে আস-সাফফাহ তার ভাই আবু জাফরকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী এবং ভাইয়ের পুত্র ঈসাকে তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যান।
আরো জানুন: আব্বাসি আন্দোলন ও উমাইয়াবিরোধী তৎপরতা, সেই সাথে তাদের পরিচয় ।