আব্বাসি আন্দোলন ও উমাইয়াবিরোধী তৎপরতা

আব্বাসি আন্দোলন ও উমাইয়াবিরোধী তৎপরতা, সেই সাথে তাদের পরিচয় ।

আব্বাসি আন্দোলন ও উমাইয়াবিরোধী তৎপরতা, সেই সাথে আব্বাসিদের পরিচয় ।
Introduction to the Abbasid and the Abbasid Movement
আব্বাসিদের পরিচয়: আব্বাসিরা মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের হাশেমি শাখা থেকে উদ্ভূত। কুরাইশ বংশের অন্য শাখাটি উমাইয়া নামে খ্যাত। মহানবি (স)-এর পিতৃব্য আল আব্বাস-বিন আবদুল মুত্তালিব-বিন হাশেমের নাম থেকেই আব্বাসি বংশের নামকরণ করা হয়েছে। আল আব্বাস চার পুত্র (আবদুল্লাহ, ফজল, উবায়দুল্লাহ ও কায়সান) রেখে ৬৫৫ খ্রিষ্টব্দে ইন্তেকাল করেন। সিফফিনের যুদ্ধের সময় (৬৫৭ খ্রি.) তারা উমাইয়া গোত্রের মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হাশেমি গোত্রের হযরত আলী (রা)-এর পক্ষাবলম্বন করেন। আত্মীয়তার দিক থেকে উমাইয়াদের তুলনায় মহানবি (স)-এর নিকটবর হওয়ায় আব্বাসিরা নিজেদের মুসলিম খিলাফতের বৈধ দাবিদার বলে মনে করতেন।

আব্বাসি আন্দোলন এর ঘটনাবলি:
আব্দুল্লাহ ও আলীর উমাইয়াবিরােধী তৎপরতা: ইবনে আব্বাস নামে পরিচিত আল আব্বাসের জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুল্লাহ ও তার অপর তিন ভাই উমাইয়াদের অধার্মিকতা ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সােচ্চার ছিলেন। একই গােত্র থেকে উদ্ভূত বলে ঐ ভাইয়েরা সিফফিন (৬৫৭ খ্রি.) ও কারবালার যুদ্ধে (৬৮০ খ্রি.) হযরত আলী (রা) ও তার বংশেদের সমর্থন করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মৃত্যুর পর তার পুত্র আলী পরিবারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আলীর মৃত্যুর পর তার পুত্র মুহাম্মদ পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। মুহাম্মদ বিন আলী যােগ্য ও উচ্চাভিলাষী ছিলেন । তিনিই ছিলেন আব্বাসি আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা এবং উমাইয়া বংশের পতন ঘটিয়ে আব্বাসি খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রথম পরিকল্পনাকারী ।

আব্বাসি আন্দোলন এর সচনা: মুহাম্মদ বিন আলী তার পূর্বপুরুষের উমাইয়াবিরোধী মনোভাবকে আন্দোলনে পরিণত করেন। আব্বাসি আন্দোলন কে সর্বমহলে গ্রহণযােগ্য করে তােলার জন্য মুহাম্মদ বিন আলী ঘোষণা করেন, ইমাম হুসাইন শাহাদত বরণের পর ইসলামের ধর্মীয় কর্তত্ব তার পুত্র আলী অথবা জয়নুল আবেদীনের উপর ন্যাস্ত না হয়ে হুসাইনের বেমাত্রেয় ভাই মুহাম্মদ আল হানাফিয়ার ওপর অর্পিত হয়েছে। মুহাম্মদ আল হানাফিয়ার ইন্তেকালেরে পর তার পুত্র হাশেম নেতৃত্বলাভ করেন। নিঃসন্তান হাশেম মৃত্যুর আগে ইমামতির দায়িত্ব অর্পণ করেন আব্বাসি বংশের তৎকালীন নেতা মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবাসের কাছে।

See also  দিউয়ান : হযরত ওমর (রা) এর দিউয়ান ও রাজস্ব প্রশাসন।

উমাইয়াবিরোধী সর্বদলীয় জোট গঠন: মুহাম্মদ বিন আলীর ব্যাপক সাংগঠনিক শক্তি ছিল। তিনি কৌশল হিসানে ঘোষণা করেন, মহানবি তথা ফাতেমি বংশের দাবি প্রতিষ্ঠা করাই আব্বাসি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। ফলে উমাইয়াদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন খারেজি, শিয়া, খােরাসানি, মাওয়ালি ইত্যাদি গােষ্ঠী এই আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় এবং উমাইয়াবিরােধী জোট গঠন করে। এই জোট সম্পর্কে ঐতিহাসিক পি কে হিভ বলেন, “ শিয়া, খােরাসানি এবং আব্বসি শক্তির একত্রীকরণে উমাইয়া বংশের অন্তিমকাল উপস্থিত হয় এবং শেষােক্ত সম্প্রদায় এটি তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগায়। “ আব্বাসি দাই বা প্রচারকদেরকে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিয়ে একটি সিনেট গঠন করা হয়। ঐ সিনেট পরিচালনার জন্য ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল গঠন করা হয় যার প্রধান ছিলেন স্বয়ং মুহাম্মদ বিন আলী। উদ্দেশ্য সিন্ধির আগেই ৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন আলী মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার এ মৃত্যু আগে তার তিন পুত্র ইব্রাহিম, আবুল আব্বাস এবং আবু জাফরকে পর্যায়ক্রমিক উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যান।

আবু মুসলিমের বিপ্লবী প্রচারণা ও খোরাসান দখল: আব্বাসি আন্দোলন কে বিপ্লবে পরিণত করার সেরা কারিগর ছিলেন আবু মুসলিম খােরাসানি নামে আরব বংশােদ্ভুত এক পারসিক মাওয়ালি। আমীর আলী বলেন, “তার অপরিবর্তনীয় শিষ্টাচার ও সৌজন্য শত্রুগণকে অনুরঞ্জিত করত এবং সমর্থন লাভে সহায়তা করত; অন্যপক্ষে তার সৈন্যদল গঠন ও শাসনকার্য পরিচালনার দক্ষতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।” মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইব্রাহিম আব্বাসি আন্দোলন এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আবু মুসলিম খােরাসানি তার অধীনে আব্বাসি আন্দোলনের প্রচারকাজ শুরু করেন। আমীর আলী তার মুসলিমকে ইতালির রেনেসাঁ যুগের কূটকৈাশলী রাজনীতিক ম্যাকিয়াভেলির মতাে চতুর বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত আবু মুসলিমের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই খােরাসান উমাইয়াবিরােধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। খােরাসানের উমাইয়া শাসনকর্তা নসর ইবনে সাইয়্যার যখন কিরমানে খারিজি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় ৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন আবু মুসলিম নিজেকে ‘আল হাশিম’ (হাশিমিদের রক্ষক) বলে ঘােষণা করেন এবং আব্বাসিদের কালাে পতাকা উত্তোলন করে রাজধানী মার্ভ ও ফারগানাসহ সমগ্র খােরাসান দখল করে নেন । খােরাসানের পলায়নপর শাসনকর্তা নসর আব্বাসি বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন।

See also  স্বধর্মত্যাগী আন্দোলন বলতে কী বােঝায়?

ইমাম ইব্রাহিমের গ্রেফতার ও হত্যাকাণ্ড: খোরাসানের পতনের পর উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইব্রাহিমকে বন্দি করার আদেশ দেন। উমাইয়াবিরােধী ইব্রাহিমকে বন্দি ও পরে হত্যা করা হয়। ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর তার ভাইয়েরা ইরাকের তৎকালীন রাজধানী কুফায় পলায়ন করেন। মৃত্যুর আগে ইব্রাহিম তার দুই ভাই আবুল আব্বাস আস সাফফাহ এবং আবু জাফর আল মনসুরকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন।

আবু মুসলিমের ইরাক দখল: ইমাম ইব্রাহিমের হত্যার পর আবু মুসলিম তার সেনাপতি কাহতাবা এবং খালিদ ইবনে বার্মাককে প্রাচীন রাজেস বা রাই শহর অভিমুখে পাঠান। উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ আবু মুসলিমের কাছে পরাজিত হলে ইরাকের রাজধানী কুফা তার অধিকারে আসে। নিহওয়ান্দ ও মেসোপটেমিয়াও আব্বাসিদের দখলে আসে।

আবুল আব্বাসকে খলিফা ঘোষণা: কুফা দখলের পর হাসান ইবনে কাহতাবার সাথে যােগ দেন আবু সালমা আল খাল্লাল নামক এক ফাতেমি সমর্থক। তারা দুজনে পরবর্তী জুম্মার দিনে খলিফা নির্বাচনের জন্য জনগণকে কুফা মসজিদে সমবেত হতে আহবান জানান। ৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ নভেম্বর শুক্রবার আবুল আব্বাস কৃষ্ণবস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে কুফা মসজিলে উপস্থিত হলে আবু সালমা আল খাল্লাল ওরফে জাফর তাকে খলিফা বলে ঘােষণা করেন। উপস্থিত সকলে উচ্চঃস্বরে ‘আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করে। আবুল আব্বাস উমাইয়াদের নৃশংসতার প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য বজ্রকঠিন শপথ নেন।

জাবের যুদ্ধ এবং উমাইয়াদের পতন: আবু মুসলিমের অপর এক সুদক্ষ সেনাপতি আবু আয়ূন দ্বিতীয় মারওয়ানের পুত্র আব্দুল্লাহকে পরাজিত করেন। পুত্র আব্দুল্লাহর পরাজয়ের গ্লানি মোচনের জন্য খলিফা ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে ১,২০,০০০ সৈন্যসহ টাইগ্রিস নদী (দজলা) অতিক্রম করে জাব নদীর দিকে অগ্রসর হন। ইতোমধ্যে আবুল আব্বাসের পিতৃব্য আবদুল্লাহ ইবনে আলীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য আবু আয়ুনের সাহায্যার্থে পাঠানাে হয়। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি একরকম বিনাযুদ্ধেই আবাসিদের বিজয় নিশ্চিত হয়। পি কে হিট্টি বলেন, “সমগ্র সিরিয়া এ যুদ্ধের পর আব্বাসিদের পদানত হয়।” দ্বিতীয় মারওয়ান দামেস্কে এসে পুনরায় সৈন্যবাহিনী গঠনের চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পলায়নের সময় তাকে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করা হয় (৫ আগস্ট ৭৫০ খ্রি.)। কুফায় আবুল আব্বাসের কাছে মারওয়ানের ছিন্ন মস্তক পাঠানাে হলে তিনি সানন্দে। আস-সাফফাহ’ বা ‘রক্তপিপাসু’ উপাধি গ্রহণ করেন। এভাবে আব্বাসিরা মহানবি (স)-এর বংশধর তথা ‘আহলে বায়াত’-এর স্বার্থরক্ষার স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ফলে মুসলিম বিশ্বে আব্বাসি নামে নতুন রাজবংশের যাত্রা শুরু হয়।

See also  উমাইয়া সাধু বলতে কী বােঝায়? কোন খলিফাকে উমাইয়া সাধু বলা হয়?

 

আরো জানুন:  আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের কারণগুলাে সংক্ষেপে উল্লেখ কর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *