খলিফা আবু জাফর আল মনসুর

খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত ।

খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত ।
Introduction, Character and Achievements of Khalifa Abu Al fafar Abu Mansur (754-775 C.E.)

পরিচয়
আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ ৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুকালে তার ভাই আবু জাফরকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যান। এ সময় খলিফা আবু জাফর আল মনসুর মক্কায় অবস্থান করছিলেন। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি দ্রুত কুফায় ফিরে আসেস এবং আল মনসুর’ বা ‘বিজয়ী’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন। খলিফা আবু জাফর আল মনসুর দীর্ঘ ২১ বছরের শাসনামলে সাম্রজ্যের শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থায়িত্বের জন্য অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাই তাকে আব্বাসি বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। আবু জাফর আল মনসুর ৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার নিকটবর্তী এক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন।

চরিত্র
দৈহিক আকৃতি ও ব্যক্তিত্ব: খলিফা আবু জাফর আল মনসুর দীর্ঘদেহী, শ্মশ্রুবিশিষ্ট, শ্যামবর্ণ ও সুশ্রী চেহারার অধিকারী ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে মূলত ধার্মিক, আদর্শবাদী, ন্যায়পরায়ণ, পরিশ্রমী ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। আবার মানুষ হিসেবে তার চরিত্রে কিছু দোষও ছিল। তার বিরুদ্ধে কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অত্যাচারী হওয়া ও অকৃতজ্ঞতার অভিযােগ ছিল।

ব্যক্তি হিসেবে: ব্যক্তি হিসেবে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর ছিলেন একজন স্নেহশীল মানুষ। পিতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ । পুত্রের জন্য আলাদা প্রাসাদ নির্মাণের বিষয়টি থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তিনি ছিলেন খাঁটি ধার্মিক ব্যক্তি। তাই ঐতিহাসিক মুর বলেন, “যদি আমরা তার চরিত্রের বিশ্বাসঘাতকতা ও নিকৃষ্ট গুণ ভুলে যাই তাহলে মনসুর সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন ভিন্নরূপ হবে।”

শাসক হিসেবে: শাসক হিসেবে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর ছিলেন নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতক। আর এ কারণেই তিনি আব্বাসীয়দের ক্ষমতায় বসানাে চাচা আব্দুল্লাহ, আলী বংশীয় ব্যক্তিবর্গ, এমনকি অকৃত্রিম বন্ধু আবু মুসলিমকেও হত্যা করতে দ্বিধাবােধ করেননি। ঐতিহাসিক মুর বলেন, মনসুরের চরিত্রে উৎকৃষ্ট গুণাবলির সমাবেশ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতক এবং নিষ্ঠুর হিসেবে ইতিহাসের রায় তার বিপক্ষেই যাবে। আমীর আলীর মতে, “নিষ্ঠুর স্বার্থপর এবং বিবেকহীন মনসুর কোনো ব্যক্তিকে নিজের বা নিজ বংশের পক্ষে সামান্যতম বিপজ্জনক বলে মনে করলেই তার প্রাণনাশ না করে ছাড়তেন না।

আব্বাসি বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আল মনসুরের কৃতিত্ব:
বিদ্রোহ দমন ও শাসন সুদৃঢ়করণ: সিংহাসনে আরােহণ করেই খলিফা আবু জাফর আল মনসুর তার চাচা ”জাবের যুদ্ধ বিজেতা” আবদুল্লাহ বিন আলীর রােষানলে পড়েন। এর জেরে তিনি আবু মুসলিম খােরাসানিকে পাঠিয়ে আবদুল্লাহ যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি করেন। সাত বছর কারাভােগের পর আবদুল্লাহকে লবণের ভিত্তির ওপর নির্মিত এক প্রসাদে স্থানান্তর করা হয়। আকস্মিক বৃষ্টিপাতে প্রাসাদটির ভিত্তি গলে যায় এবং এর ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে হতভাগ্য বন্দি আবদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। মনসর এরপর নিজের শাসনের জন্য হুমকি মনে করায় আবু মুসলিমকেও কৌশলে রাজদরবারে ডেকে এনে হত্যা করেন। আমীর আলীর ভাষায়, “আবু মুসলিম যতদিন জীবিত ছিলেন আল মনসুর ততদিন নিজেকে নিরাপদ ভাবেননি,প্রকৃতপক্ষে তিনি তখন (মুসলিমকে হত্যার পর) নিজেকে প্রকৃত রাষ্ট্রপ্রধান মনে করতে লাগলেন।” আবু মসলিমের হত্যাকন্ডে আব্বাসি’ শাসনের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক ঘটনা । ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেন, “মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক আবু মুসলিম তার অসাধারণ ধীশক্তি এবং বীরত্বের দ্বারা উমাইয়াদের ধ্বংসস্তুপের ওপর আব্বাসি শাসন প্রতিষ্ঠা করে ইসলামের ধ্যান-ধারণার অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করেন। তা সত্ত্বেও আব্বাসি বংশের ভবিষ্যৎ বিপদের কথা চিন্তা করে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর তাকে হত্যার মতাে হীন কাজটি করেন। ৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মাজুসি সম্প্রদায়ের নেতা সানবাদের নেতৃত্বে পারসিকরা আবু মুসলিম খােরাসানির বর্বরােচিত হত্যার প্রতিবাদে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। তখন আল মনসুর এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠালে সানবাদ পরাজিত ও নিহত হন। সানবাদের বিদ্রোহ দমনের পর তিনি ৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রাওয়ান্দিয়া এবং ৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে খােরাসানের বিদ্রোহ দমন করেন। আল মনসুর এরপর আরও কয়েকটি অভিযান চালান। এর প্রথমদিকে সাফল্য না পেলেও তিনি ৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াজিদ বিন হাসান মুহাল্লিবের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ইফ্রিকিয়ার বার্বার ও খারেজি বিদ্রোহীদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। এর পরে ” আবাসি আন্দোলনে সহায়তাকারী আলীর বংশধরদের হাতে ক্ষমতা প্রদান না করায় ক্ষুব্ধ আলী বংশীয় সমর্থক শিয়র মসলিমদের ইমাম মুহাম্মদ (আন-নফস-উজ জাকিয়া বা পবিত্র আত্মা নামে খ্যাত) ও ইব্রাহিম যথাক্রমে মদিনা ও বসরায় বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। খলিফা আবু জাফর আল মনসুর তাদের পরাজিত ও হত্যা করে আব্বাসি রাজবংশকে বিপদমুক্ত করেন। মদিনা , কুফা ও বসরায় মুহাম্মদ ও ইব্রাহিমের অসংখ্য সমর্থককে হত্যা করা হয়। ইমাম হাসান (রা) ও ইমাম হসাইন (রা) এর বংশদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এমনকি ইমাম জাফর আস্ সাদিকের মতাে ধার্মিক পুণ্যাত্মার ওপর নির্যাতন চালানো হয় । হানাফি মাজহাবের প্রবর্তক ইমাম আবু হানিফা (র) ও মালেকি মাজহাবের প্রবর্তক ইমাম মালিক (র) কে কারারুদ্ধ করে চাবুক মারা হয়। আলী বংশীয় এবং তাদের সমর্থকদের দমনে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর যে নির্মমতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাকে ইতিহাসবিদরা আব্বাসি খিলাফতের একটি কলঙ্কজনক দিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।

See also  উষ্ট্রের যুদ্ধ কী? ইসলামের ইতিহাসে উষ্ট্রের যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিলো?

রাজ্যবিস্তার: অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের পর খলিফা আবু জাফর আল মনসুর আব্বাসি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির জন্য ৭৫৯-৭৬০ ” খ্রিস্টাব্দে পুত্র মাহদীকে অভিযানে পাঠিয়ে তাবারিস্তান ও গিলান জয় করেন। এ অঞল জয় করার পরই তিনি কাস্পিয়ান সাগরে পশ্চিম-উত্তরে অবস্থিত দায়লামকে আব্বাসি সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। খালিদ-বিন বার্মাককে এখানকার শাসক নিযুক্ত করে এশিয়া মাইনরে আব্বাসি শাসনের ভিত্তি দঢ় করেন। আল-মনসুরের সময় স্পেন প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
উমাইয়া খলিফা হিশামের পৌত্র আব্দুর রহমান আব্বাসিদের হাত থেকে পলায়ন করে বেছে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থান ঘুরে অবশেষে তিনি ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া রাজ্য (আমিরাত) প্রতিষ্ঠা করেন। তখনকার বহুধাবিভক্ত স্পেনের ওপর আবদুর রহমান প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা আবু জাফর আল মনসুর স্পেনে অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হন। আব্দুর রহমান আব্বাসি সেনাপতিকে পরাজিত করে তার ছিন্ন মস্তকটি আল মনসুরের দরবারে পাঠিয়ে দেন। আব্দুর রহমানের ঔদ্ধত্য ও নৃশংসতায় খলিফা মনসুর বিস্মিত হয়ে তাকে কুরাইশদের বাজপাখি’ (The Falcon of the Quraish) বলে অভিহিত করেন। খলিফা আল মনসুর কখনই স্পেন জয় করতে পারেননি। তবে তার রাজত্বের শেষের দিকে আফ্রিকায় আব্বাসি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

এদিকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে খলিফার ব্যস্ততার সুযােগে রােমানরা আব্বাসি সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের মালাতিয়া দুর্গ দখল করে নেয়। ৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা সেনাপতি সালেহ ও আব্বাসের নেতৃতে রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রােমান সম্রাট চতুর্থ কনস্টানটাইন বার্ষিক করদানে সম্মত হন। মালাতিয়া দুর্গ পুনরায় আব্বাসি অধিকারে আসে।

বাগদাদ নগরীর প্রতিষ্ঠা: প্রশাসনকে সুবিন্যস্ত, গতিশীল ও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর ৭৬২ খ্রিষ্টার রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে স্থানান্তরিত করেন। এ সময়ে দজলা (টাইগ্রিস) নদীর পশ্চিম তীরে ৪৮ লক্ষ ৮০ হাজার দিরহাম ব্যয় করে সুপরিকল্পিত এক নগরী প্রতিষ্ঠা করা হয়। হিট্টির ভাষায়, “নতুন জায়গায় রাজধানী স্থাপিত হওয়ায় ভৌগােলিক দিক দিয়ে প্রাচ্যের সাথে ভাবের আদান-প্রদানের সুযােগ তৈরি হলাে।” এ নতুন নগরীর নামকরণ করা হয়েছিল দার-আস সালাম (শান্তির নিবাস)। অনেকে খলিফার নামানুসারে একে মানসুরিয়া বলেও আখ্যায়িত করেন।

See also  খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা হয় কেন?

সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি: সামরিক শক্তিই সাম্রাজ্যের মূলভিত্তি— এ সত্যকে অনুধাবন করে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর একটি সুপ্রশিক্ষিত শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন। এ ছাড়া সাম্রাজ্যের সকল দপ্তরের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হচ্ছে কিনা, শত্রু কর্তৃক দেশ আক্রান্ত হতে পারে কিনা, কেউ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রসহ কোনােরূপ রাষ্ট্রবিরােধী কাজে লিপ্ত কিনা ইত্যাদি তা জানার জন্য তিনি গুপ্তচর নিয়ােগ করেন। ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ভিত্তি ও নিরাপত্তা সুদৃঢ় হয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপােষকতা ।
অনুবাদ বিভাগ স্থাপন : খলিফা আবু জাফর আল মনসুর জ্ঞান-বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। বিভিন্ন সভ্যতার ও ভাষার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য তিনি একটি অনুবাদ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। মনসুরের পৃষ্ঠপােষকতায় ইবন মুকাফফা সংস্কৃত থেকে সর্বজনবিদিত পশুপক্ষীর গল্প (Animal fables) আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন মনসুরের নির্দেশেই ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ ’খণ্ডকা-খাদ্যকা’ এবং উপদেশমূলক গল্পপুস্তক ‘হিতােপদেশ’ আরবি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল ।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন: খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর রাজত্বকালে গণিতশাস্ত্রের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। মনসুর নিজেও – বিজ্ঞানশাস্ত্রের একজন সুপণ্ডিত অনুদিত ছিলেন। তার আমলে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন ভারতীয়, জ্যোতিবিদ্যা গ্রন্থের প্রভাবে আরবি ভাষায় জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ প্রণীত হতে থাকে। আল মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতায় আরব জ্যোতির্বিদ মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম আল ফাজারী জ্যোতির্বিদ্যার ওপর লিখিত সংস্কৃত ভাষার গ্রন্থ (জ্যাতির্বিদ্যা বিষয়ক) সিদ্ধান্ত (Siddhanta) আরবিতে অনুবাদ করেন। মনসুরের দরবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ছিলেন ইবন মুকাফফা (Ibn Mukaffa) খলিফার পষ্ঠপােষকতায় ইবনে মুকাফা ‘খুদাইনামা’ নামক পাহলভী ভাষায় লিখিত রূপকথা, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থ সিয়ার আল-মুলুক আল আযম (Siyar Al-Mulk Al-Ajam) নামে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। খলিফা আল মনসুর এরিস্টটল, ইউক্লিড, টলেমি প্রমুখ খ্যাতনামা গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞদের বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থও আরবি অনুবাদের ব্যবস্থা করেন।

অন্যান্য কৃতিত
কুরআন-হাদিস সংরক্ষণ সংকলন: পবিত্র আল কুরআনের প্রাসঙ্গিক টীকা-টিপ্পনী অথবা তাফসিরের চর্চা এবং হাদিস মহানবী (সা) এর বাণীসমূহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর খ্যাতি অর্জন করেন। একই সাথে তিনি প্রাচীন কবিতাসমূহের সংরক্ষণের উদ্যেগ গ্রহণ করেন।

See also  প্রথম খলিফা: ওমর রা. আবু বকর রা. কে প্রথম খলিফা নির্বাচিত করতে চাইলেন।

স্থাপত্যশিল্পের পিষ্ঠপােষকতা: খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর আমলে পারসিক (ইরানি) স্থাপত্যের প্রভাবে আব্বাসি স্থাপত্যশিল্পের উন্মেষ ঘটে। ৭৬২-৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ৪৮,৮৩,০০০ দিরহাম ব্যয়ে সুরম্য বাগদাদ নগরী নির্মাণ তারই অবিস্মরণীয় কীর্তি। বাকদাদকে তখন মদিনা-আস-সালাম বা শান্তির শহরও বলা হতাে। এ ছাড়া তিনি কাসর-আল-খুলদ (Qasr-Al-Khuld) এবং রুসাফা (Rusafa) নামে দুটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ক্রেসওয়েলের মতে, আল মনসুর ৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে রাক্কায় একটি রাজপ্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণ করেন।

নতুন সভ্যতার জনক: খলিফা আল মনসুর ছিলেন একটি নতুন সভ্যতার জনক। তার খিলাফতে আরবীয়, ভারতীয়, গ্রিক এবং ইরানি সভ্যতার সংমিশ্রণে যে নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে তা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। এই নতুন সভ্যতা ইসলামি সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সুন্নি মতবাদের পৃষ্ঠপােষকতাঃ আব্বাসীয় আন্দোলনে শিয়া মুসলিমরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের থেকে সিংহাসন নিরাপদ রাখার বাসনায় আল মনসুর সুন্নি মতবাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপােষকতা দান করেন। তিনি ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক এর মতাে সুন্নি ধর্মীয় নেতাদের অপমান করলেও সুন্নি মতবাদকে পৃষ্ঠপােষকতা দেন। এ কাজটি রাজনৈতিক বিবেচনায় সঠিক ছিল বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন। পি.কে. হিট্টি বলেন, “মুয়াবিয়ার নীতিমালা যেভাবে উমাইয়াদের পথ প্রদর্শন করে ঠিক সেভাবে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর নীতিসমূহ অনেক যুগ ধরে তার বংশধরদের পরিচালিত
করে।”

জনকল্যাণকর শাসন প্রতিষ্ঠা : একজন প্রজারঞ্জক শাসক হিসেবে খলিফা আল মনসুর সাম্রাজ্যে বহু নগর, সরাইখানা, সড়ক ও চিকিৎসালয় নির্মাণ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজের উন্নয়নের জন্যও তিনি নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসব। উদ্যোগ সাম্রাজ্যের জনগণের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
আব্বাস আস সাফফাহ (৭৫০-৭৫৪ খ্রি.) শুধ আব্বাসি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন রাজ্যবিস্তার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে তার ভাই আবু জাফর আল মনসুর এ বংশের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেন। আবু জাফর রাজ্যের ভিত্তি সুসংহত করার পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনার চেষ্টা করেন। তাই তাকেই আব্বাসি বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দেওয়া হয়।

আরো জানুন: আবুল আব্বাস আস সাফফাহ (রক্তপিপাসু) এর পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত্ব ।

আরো জানুন: আব্বাসি আন্দোলন ও উমাইয়াবিরোধী তৎপরতা, সেই সাথে তাদের পরিচয় ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *