আবদুল মালিকের শাসননীতি ও সংস্কার। দিউয়ানুল রাসায়েল

আবদুল মালিকের শাসননীতি ও সংস্কার
Administrative Policy and Reforms of Khalifa Abdul Malik

শুধু উমাইয়া সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়ীকরণ ও সম্প্রসারণ নয়, খলিফা আবদুল মালিক শাসননীতি প্রণয়ন ও শাসনব্যবস্থার সংস্কারেও মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দেন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা)-এর পরই তার স্থান বলে ঐতহাসিকেরা মনে করেন। ঐতিহাসিক স্কলার বলেন, “আবদুল মালিকের রাজত্বকাল ইসলামের ইতিহাসে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ ছিল।” তার গৃহীত শাসননীতি ও সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল—

আরব জাতীয়তাবাদী নীতি প্রবর্তন:
খলিফা আবদুল মালিকের রাজত্বকাল উমাইয়া বংশের সবচেয়ে গৌরবময় যুগ (Glorious Age of the Umayyad)। তার শাসননীতির মূল বিষয় ছিল আরব জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ। তিনি শাসনক্ষমতায় বসে দেখলেন যে, আরব মুসলিমরা রাজ্যশাসন করলেও মূলত অনারব জনগােষ্ঠী, বিশেষ করে পারসিক ও রোমানরা উমাইয়া খিলাফতের প্রশাসন পরিচালনা করছে। এমতাবস্থায় প্রশাসনে বিজাতীয় প্রভাব হ্রাস এবং আরব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খলিফা রাজকীয় দফতরসমূহে কেবল আরবি ভাষাভাষীদের চাকরি দেওয়ার বিধান চালু করেন। অবশ্য এর দ্বারা প্রশাসনে যে আরব জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নয়। বহু অনারব দ্রত আরবি ভাষা রপ্ত করে প্রশাসনে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখেন। ঐতিহাসিক পি. কে হিট্টি বলেন, “প্রশাসনকে আরবীয়করণ, প্রথম বিশুদ্ধ
আরবি মুদ্রার প্রচলন, ডাক বিভাগের উন্নতি সাধন এবং জেরুজালেমে ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থাপত্য ’কুব্বাতুস সাখরা’ নির্মাণ এ যুগের আরব জাতীয়তাবাদের সাক্ষ্য দেয়।

সরকারি অফিসে আরবি ভাষা প্রচলন:
খলিফা আবদুল মালিক রাষ্ট্রে আরব জাতীয়তাবাদের প্রতিফলন ঘটানাে এবং সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ফারসি, সিরীয় ও গ্রিকসহ প্রচলিত বিভিন্ন ভাষার উচ্ছেদ সাধন করে আরবিকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদাদান করেন। ৬৯৬-৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ মর্মে একটি আদেশ জারি করেন। সালিহ বিন আব্দুর রহমান নামে জনৈক পারসিক মুসলমানের পরামর্শে তিনি সরকারি কাজে আরবি ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ফলে সিরিয়া ও ইরাকের প্রদেশসমূহে আরবি ভাষায় সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার নিয়ম প্রবর্তিত হয়। পরে মিসর ও পারস্যেও আরবি ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে। পি. কে. হিট্টি বলেন, “এ যুগেই প্রশাসনের জাতীয়করণ বা আরাে স্পষ্ট করে বললে আরবীয়করণ হয়।” এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে-
১. আঞ্চলিক ভাষাসমূহের পরিবর্তে অফিস আদালতে দলিল-পত্রাদি আরবি ভাষায় রক্ষিত হওয়ার নিয়ম চালু হয়;

See also  উমাইয়াদের পতন:খলিফাদের সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাবকে পতনের কারণ

২. সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্যে একই ধরনের শাসনব্যবস্খা প্রচলিত হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত থাকায় শাসনকার্যে যে অসুবিধা হতাে তার অবসান হয়;

৩. বিশুদ্ধ আরব শাসন প্রচলিত হওয়ায় আরবি ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়;

৪. এ ব্যবস্থার ফলে সাম্রাজ্যের অনারব অমুসলমানরা কর্মচ্যুত হলে তাদের স্থলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগে আরব মুসলমানরা নিযুক্ত হন। তবে অনারবদের মধ্যে যারা আরবি ভাষায় দক্ষ ছিলেন তাদেরকে চাকরিতে বহাল রাখা হয়।

আরবি লিপির উন্নতি বিধান:
আরবি ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করার ফলে গােটা সাম্রাজ্যে এটি প্রচলিত হয়। ফলে এর প্রকৃত উচ্চারণের জন্য আরবি লিপির সংস্কার করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। খলিফা আবদুল মালিকের পূর্বে আরবি লিপির দুটি বড় ত্রুটি ছিল। যেমন এতে শুধু ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল। হরকতের অভাবে একই শব্দের বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণ হতাে। আরবি ভাষা সহজভাবে লিখন ও পঠনের ক্ষেত্রে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সহযােগিতা করেন। তিনি আরবি লিপিতে হরকত ব্যবহার ও একই হরফের বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণের জন্য নােকতার ব্যবহার প্রবর্তন করেন। ফলে আরবি ভাষার ও লিখন সহজতর হয় এবং অনারবরা সহজেই আরবি শিখতে ও বলতে সক্ষম হয়।

আরবি মুদ্রার প্রচলন:
মুদ্রা হলাে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। আরব সাম্রাজ্যে ইতােপূর্বে কোনাে একক মুদ্রা ছিল না। আবদুল মালিকের রাজত্বের সময় পর্যন্ত তিন ধরনের মুদ্রা ছিল। যেমন: বাইজান্টাইনে Dinarious, পারসিক Darkmah এবং দক্ষিণ ইয়ামেনে Athene নামক মুদ্রা চালু ছিল, ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমস্যা হতাে। মুদ্রা বিনিময়ের সমস্যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা দেখা দিত। এছাড়া মুদ্রার ছাপ ও মূল্যমান একেবারে অনির্ধারিত থাকায় বাজারে অনায়াসে জাল মুদ্রা প্রচলিত হতাে। এ সব অসুবিধা লক্ষ করে খলিফা আবদুল মালিক সর্বপ্রথম খাটি আরবি মুদ্রার প্রচলনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। জাতীয় মুদ্রা প্রচলনের জন্য ৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দামেস্কে একটি কেন্দ্রীয় টাকশাল স্থাপন করেন। আমীর আলী বলেন, ‘আবদুল মালিক ইসলামে সর্বপ্রথম টাকশালের প্রবর্তন করেন। খলিফা আবদুল মালিক দিনার, দিরহাম ও ফালুস নামের স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেন। মুদ্রাগুলােকে জাতীয়করণের জন্য এতে ক্রসের পরিবর্তে আরবি বর্ণমালা লেখা হয়।

See also  সিন্ধু বিজয়ের প্রত্যক্ষ কারণ টি লেখাে। ইতিহাসে সিন্ধু বিজয় কেনো গুরুত্বপূর্ণ?

রাজস্ব সংস্কার:
খলিফা আবদুল মালিক রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে রাজ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটানাের জন্য কিছু উদ্যোগ নেন। তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরামর্শে কিছু নীতি গ্রহণ করেন। যেমন-
১. ইসলাম গ্রহণ করলেও মাওয়ালিদের জিজিয়া ও খারাজ দিতে হবে,
২. সেনাবাহিনীতে যােগ দিলেও তাদের গ্রামে গিয়ে স্ব-স্ব পেশায় নিযুক্ত হতে হবে,
৩, মুসলমানরা যে জমি ক্রয় করেছে তার জন্য তাদেরকে আগের মতাে প্রচলিত কর দিতে হবে,
৪. অনাবাদি জমি ও জলাভূমির জল নিষ্কাশন করে সেগুলাে চাষ করতে হবে। এ জন্য কৃষকদের কিছু সুবিধা দেওয়া হয়। চাষাবাদে সেচ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন খাল খনন এবং ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যকার সংযােগ খালসমূহ সংস্কার করা হয়। পতিত ও অনাবাদি ভূমি চাষযােগ্য করা হলে তিন বছরের জন্য তার রাজস্ব মওকুফ করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষিঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এসব বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে রাজ্যের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক সংকট কেটে যায়।

ডাক বিভাগের সংস্কার:
খলিফা আবদুল মালিক পারসিকদের পদ্ধতি অনুযায়ী ডাক চালান (Relay of Horses) প্রথার প্রচলন করেন। তিনি সাম্রাজ্যের বড় রাস্তার পাশে ডাকচৌকি নির্মাণ করেন। ডাক বিভাগের কাজ ছিল-
১. সরকারি চিঠিপত্র, আদেশ-নিষেধ আদান-প্রদান;
২. সরকারি কর্মচারীদের ডাক গাড়ির মাধ্যমে স্থানান্তর ;
৩. প্রয়ােজনে যুদ্ধক্ষেত্রে দুত সৈন্য ও রসদ দ্রব্যাদি সরবরাহ এবং
৪. গােয়েন্দা বিভাগের কাজ সম্পাদন। এ জন্য ডাক বিভাগকে ‘খলিফার কান এবং চোখ’ (Ear and Eyes of the Caliph) বলা হতাে।

রেজিস্ট্রি বিভাগের সংস্কার:
খলিফা মালিকের আরেকটি বড় কৃতিত্ব হলাে দামেস্কে মহাফেজখানা বা দস্তাবেজখানা প্রবর্তন। “দিউয়ানুল রাসায়েল’ নামের এ দফতরে খলিফার আদেশ, নিষেধ, দস্তাবেজ, চুক্তিপত্র, নথিপত্র ইত্যাদি সংরক্ষণ করে রাখা হতাে।

বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও সংস্কার:
খলিফা আবদুল মালিক সাম্রাজ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য ‘দিউয়ানুল কাযা’ নামে একটি দফতর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রদেশে বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য তিনি কাজি নিয়ােগ করেন। কেন্দ্রীয় বিচারালয়ে ‘কাজি-উল-কুজ্জাত’ বিচারকাজ সম্পাদন করতেন। খলিফা স্বয়ং প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করতেন।

See also  খলিফা আবদুল মালিক এর পরিচিতি, খিলাফত, সাম্রাজ্য সুদৃঢ়ীকরণ ও সম্প্রসারণ

 

 

 

আরো জানুন: আব্বাসি আন্দোলন ও উমাইয়াবিরোধী তৎপরতা, সেই সাথে তাদের পরিচয় ।

আবুল আব্বাস আস সাফফাহ (রক্তপিপাসু) এর পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত্ব ।

খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *