খলিফা আব্দুল মালিকের চরিত্র ও কৃতিত্ব। উমাইয়া খিলাফতের পঞ্চম খলিফা….

খলিফা আব্দুল মালিকের চরিত্র ও কৃতিত্ব।
Character and Achievements of Khalifa Abdul Malik

চরিত্র :
উমাইয়া বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা খলিফা আবদুল মালিক ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, দৃঢ়সংকল্প, সাহসী ও উদ্যমী একজন ব্যক্তি । তিনি একই সাথে ছিলেন দক্ষ কূটনীতিক ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী । খিলাফত লাভের পূর্বে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ কিন্তু খিলাফত লাভের পর তিনি পবিত্র কুরআন শরিফ হাতে নিয়ে বলেন, ‘তােমার সাথে এই আমার শেষ দেখা। কিন্তু তিনি নিজের খেয়ালখুশি মতাে রাজ্য শাসন করেছেন বলে ঐতিহাসিকদের অনেকেই তার সমালােচনা করেছেন। কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক আবদুল লােভী ও নিষ্ঠুর বললেও সৈয়দ আমীর আলী তাকে ফ্রান্সের শাসক শার্লিমেন, রাশিয়ার জার মহামতি পিটার এবং রােমের সম্রাট দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ানের চেয়ে মহানুভব শাসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক রেজা-ই-করিম বলেন, “আমর বিন সাঈদের কাহিনিটি বাদ দিলে আবদুল মালিকের প্রত্যেক কাজেই বুদ্ধিমত্তা, উদারতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে হাজ্জাজের নিষ্ঠুর কার্যাবল আব্দুল মালিকের খিলাফতের এক বিরাট কলঙ্ক।”
খলিফা আবদুল মালিক নিজে একজন কবি ছিলেন এবং কবি ও জ্ঞানী-গুণীদের উদারভাবে পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। তায়াযুক নামে এক খ্রিষ্টান ব্যক্তি ছিলেন খলিফার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। সারজিয়াস নামের আর একজন খ্রিষ্টান তার পরামর্শক ছিলেন। খলিফা আবদুল মালিকের দোষ-গুণের বিচার করলে তার গুণের পরিমাণই বেশি হবে। তিনি যে খারাপ কাজগুলাে করেছিলেন, মধ্যযুগে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একজন দক্ষ শাসকের সেগুলাের প্রয়ােজন ছিল। তিনি তার অসামান্য বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টি দিয়ে উমাইয়া বংশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে উমাইয়া খিলাফতকে সুসংহত করেন। পি. কে. হিট্টি বলেন, আবদুল মালিক ও তার চার পুত্রের শাসনে দামেস্কে এই রাজবংশ ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌছায়। এ জন্য তাকে নিঃসন্দেহে উমাইয়া খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাও বলা যায়।

কৃতিত্ব:
বিদ্রোহ দমন; প্রায়শ্চিত্তকারী দল আল মুখতারের নেতৃত্বে কুফাতে সংগঠিত হয় এবং কুফাসহ কিছু এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে বসরার গভর্নর মুসাবের এলাকায় আঘাত হানে। কুফার অধিবাসীরা মুসাবকে আমন্ত্রণ জানায়। এদিকে আবদুল্লাহ ও মুখতারের বিবাদের সুযােগে আবদুল মালিক ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে মুখতারের বিরুদ্ধে পাঠান। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ নিহত হন এবং জাবের যুদ্ধে মুখতার মুসাবের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। এভাবে মালিকের এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তার অপর প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বারা ধ্বংস হয়। এরপর তিনি সিংহাসনের দাবিদার খালিদ বিন ইয়াজিদকে প্রলােভন দেখিয়ে নিজের দলে টানেন এবং আমর বিন সাইদকে কৌশলে রাজপ্রাসাদে আহ্বান করে নিজ হাতে হত্যা করেন। মুসাবকে দমন করার জন্য খলিফা নিজে যুদ্ধাভিযানে গেলে মুসাব ভীত হয়ে সেনাপতি মুহাল্লাবের সাহায্য প্রার্থনা করেন। যুদ্ধে মুসাব নিহত হন। তার ছিন্ন মস্তক দামেস্কে প্রেরণ করা হয়। আবদুল মালিক এরপর বাবার নেতা কুসাইলা ও কাহিনার বিদ্রোহ দমন করেন। আবদুল মালিক তার চরম প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে দমনের জন্য জেরুজালেমে কুব্বাতুস সাখরা (Dome of the Rock) তৈরি করে সেখানে মুসলমানদের হজ পালনের নির্দেশ দেন। কিন্তু তার এ উদ্দেশ্য সফল হয়নি । তবে তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পাঠিয়ে তিনি আবদুল্লাহ বিন জুবায়েরকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এরপর হাজ্জাজের ওপর খারেজিদের দমন করার ভার দেওয়া হলে তিনি তাদের দমন করে তাদের ঘাঁটিগুলােও ধ্বংস করে দেন।

See also  কারবালার হত্যাকাণ্ড কে বিষাদময় ঘটনা বলা হয় কেন?

বাইজান্টাইনদের সাথে যুদ্ধ:
আবদুল মালিক যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন বিশৃঙ্খলার সুযােগে বাইজান্টাইন দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ান নতুন করে উমাইয়াদের বিরােধিতা শুরু করে। তারা লেবাননে আক্রমণ চালিয়ে কিছু এলাকা দখল করে। খলিফা নিজের অবস্থান নিরাপদ করে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে জাস্টিনিয়ান পরাজিত হয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে আবদুল মালিক ছিলেন বিদ্যান ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন। তিনি শিল্প, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির একজন উদার পৃষ্ঠপােষক হিসেবে ঐতিহাসিকদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। খলিফা নিজে একজন কবি ছিলেন এবং কাব্যপ্রিয় মানুষ হিসেবে তিনি সমকালের বিখ্যাত আরবি কবি আল জারিব, ফারাজদাক ও আখতাল প্রমুখকে উদার পৃষ্ঠপােষকতা দান করেন। নির্মাতা হিসেবে আবদুল মালিকের কৃতিত্ব অপরিসীম। দজলা নদীর পশ্চিম তীরে সামরিক শহর ‘ওয়াসিত ও আল আকসা মসজিদ তার স্থাপত্য কীর্তির উজ্জ্বল নিদর্শন। তবে স্থাপত্য শিল্পে তার সবচেয়ে বড় কীর্তি হচ্ছে কুব্বাতুস সাখরা Dome of the Rock নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ। মক্কায় নিজেকে খলিফা ঘােষণাকারী আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের সাথে পাল্লা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাবাগৃহের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবদুল মালিক ৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমে মহানবি (স)-এর মিরাজের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র পাথরের ওপর অষ্টাকোণাকৃতির এ স্থাপত্যকীর্তিটি নির্মাণ করেন। খলিফা আবদুল মালিক তার অনুসারীদের মক্কার পরিবর্তে এখানে হজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সার্বিক দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, মুয়াবিয়া উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন, তবে তার দুর্বল উত্তরাধি শাসনামলে নবীন উমাইয়া খিলাফত সংকটের আবর্তে নিপতিত হয়েছিল। আবদুল মালিক তার অসামান্য নৈপুণ্য দ্বারা এ সাম্রাজ্যের সংহতি বিধান করেন, সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেন ও এর সীমা সম্প্রসারণ করেন । ন্যায়সংগতভাবে তাকে উমাইয়া খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *