হযরত ওমর (রা) এর প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা।
The Provincial Administration of Hazrat Umar (R)
প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সমগ্র সাম্রাজ্যকে মােট ১৪টি প্রদেশে বিন্যস্ত করে প্রদেশগুলােতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। প্রত্যেক প্রদেশকে আবার কতগুলাে জেলায় ভাগ করেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে বলা হতো ওয়ালী এবং জেলার শাসনকর্তাকে বলা হতাে আমিল । প্রদেশে বিচারের জন্য কাজি এবং কোষাগারের জন্য কোষাধ্যক্ষ থাকতেন
শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ :
খলিফা ওমর (রা) খিলাফতে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করেন। তিনি সামরিক ও প্রশাসনিক প্রয়ােজনে সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৪টি প্রদেশে বিভক্ত করেন । যথা- মক্কা, মদিনা, আল-জাজিরা, সিরিয়া, কুফা, বসরা, মিসর, ফিলিস্তিন, ফারস, কিরমান, খােরাসান, মাকরান সিজিস্তান ও আজারবাইজান। তিনি প্রশাসনিক সুবিধার্থে প্রদেশগুলােকে জেলায় এবং জেলাকে মহকুমায় বিভক্ত করেন। প্রদেশের শাসনকর্তাকে ওয়ালি এবং জেলার শাসনকর্তাকে আমিল বলা হতাে।
প্রদেশ ও জেলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও ক্ষমতা :
মজলিশে শুরার পরামর্শক্রমে ওমর (রা) প্রত্যেক প্রদেশে একজন যােগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ওয়ালি বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে নিয়ােগদান করতেন। ওয়ালিগণ শুধু প্রাদেশিক শাসনকর্তাই ছিলেন না, তারা ছিলেন সংশ্লিষ্ট প্রদেশের সর্বোচ্চ সামরিক, ধর্মীয় ও রাজস্ব বিভাগের প্রধান । সুষ্ঠু শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি একজন কাতিব (প্রধান উপদেষ্টা), একজন কাতিব উদ-দিউয়ান (প্রধান সামরিক উপদেষ্টা), একজন সাহিব-উল-খারাজ (রাজস্ব উপদেষ্টা), একজন সাহিব-উল আহদাস (পুলিশ উপদেষ্টা) একজন সাহিব-উল-বায়তুল মাল (কোষাধ্যক্ষ), একজন কাজি বা বিচারক এবং আরাে অনেক কর্মচারীর সহযােগিতা নিতেন। তবে কেন্দ্রের মতাে প্রদেশের প্রত্যেক দফতরই স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করত। প্রদেশের আয়তন ও কার্যক্রম বিবেচনা করে ওয়ালিগণ প্রদেশকে কতকগুলাে জেলায় বিভক্ত করতেন। এসব জেলার প্রশাসককে ‘আল-আমিল’ বলা হতাে। বড় বড় জেলাকে আবার কতকগুলাে মহকুমায় (Sub-Division) বিভক্ত করা হতাে। ওয়ালি এবং আমিলগণ তাদের কাজের জন্য খলিফার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন। প্রতিবছর হজের মৌসুমে খলিফা তাদের কাছে প্রশাসনিক আয়-ব্যয়ের হিসাব গ্রহণ করতেন।
প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের সুযােগ-সুবিধা :
কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের মতােই প্রাদেশিক কর্মকর্তারা সরকারি নানা সুযােগ-সুবিধা ভােগ করতেন। প্রশাসকগণ নিয়মিত বেতনসহ রেশন পেতেন। বেতনের পরিমাণও ছিল উচ্চ। ওয়ালিগণ বার্ষিক ৬০০ দিরহামসহ দৈনিক রেশন পেতেন। এছাড়া প্রাদেশিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রদেশ থেকে যে আয় হতাে তা থেকে ব্যয় নির্বাহ করে বাকি অর্থ কেন্দ্রে জমা দিতেন। সমাজে ওয়ালি, আমিল, কাজি, কাতিব আল দিওয়ান, সাহিব আল বায়তুল মালের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ছিল। খলিফা ওমর (রা) ওয়ালি ও বিভিন্ন প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের শাসনকার্য পরিচালনা ও কর্তব্য পালনের জন্যে নিয়মিতভাবে পরামর্শ প্রদান করতেন। এরপরও যদি কোনাে প্রাদেশিক কর্মকর্তা দুর্নীতির আশ্রয় নেয় তাহলে তিনি তাদের বিরদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা এবং নানারকম শাস্তি প্রদান করতেন। দুর্নীতির অভিযােগে তিনি আবু হুরায়রা (রা) এবং আমর ইবনুল আসকে পদচ্যুত ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন।
বিচার বিভাগ :
নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য রাসুল (স)-এর সময় থেকেই বিচার বিভাগের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রতি প্রদেশে একজন করে কাজি নিযুক্ত করতেন। হযরত ওমরের (রা) সময় বিচার বিভাগ দৃঢ়ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা, বিচারক নিয়ােগ ও রায় প্রদানের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন করা হয়। বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কাজি বলা হতাে। কেন্দ্রে খলিফা নিজেই প্রধান কাজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। যােগ্যতার ভিত্তিতে কাজি নিয়ােগ দেওয়া হতাে। খলিফা ওমর (রা) কাজিদের উপযুক্ত বেতন দিতেন। কাজিদের দায়িত্ব ছিল বিবাদ নিষ্পত্তি করা, অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, ওয়াকফ সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করা,ওছিয়ত কার্যকর করা, বিধবাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা, নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করা, জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ সাধন, অধীনস্থদের ওপর কর্তৃত্ব রাখা এবং তাদের আচরণের ওপর লক্ষ রাখা। সর্বোপরি দুর্বলকে সবলের হাত থেকে রক্ষা । বিচারালয় হিসেবে মসজিদকে ব্যবহার করা হতাে। বাদী ও বিবাদীকে আইনি পরামর্শ প্রদানের জন্য খলিফা ওমর (রা) মুফতি বা আইন বিশেষজ্ঞ নিয়ােগ করেন। বিচার করার ক্ষেত্রে হযরত ওমর (রা)-এর নির্দেশ ছিল- যেসব মুসলমানকে কোনাে দিন শাস্তি দেওয়া হয়নি এবং যার সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি, কেবল তাদের সাক্ষ্যই গৃহীত হবে। ওয়ালি, আমিল, কাজি প্রমুখ উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ােগের সময় তাদের বিষয়-সম্পত্তির তালিকা নেওয়া হতাে। উৎকোচ (ঘুষ) গ্রহণের প্রমাণ পেলে তাদের বরখাস্ত করা হতাে এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতাে। মসজিদ গৃহই বিচারালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। বিচারের জন্য কোনাে প্রকার ফি লাগত না।
জনহিতকর কাজ :
হযরত ওমর (রা) জনহিতকর কাজের জন্য কোনাে বিভাগ গঠন না করলে- বিভিন্ন প্রকার রাজস্ব আয় থেকে জনকল্যাণে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রতিটি জেলায়, প্রদেশে, মহকুমায় রাস্তা-ঘাট, সেতু, নালা, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। পানি নিষ্কাশনের জন্য ছােট ছােট নালা ছাড়াও পানি সরবরাহ ও নৌচলাচলের জন্য বড় খাল খনন করা হয়। দজলা নদী থেকে ‘নাহরুল মাকীম’ লােহিত সাগর ও নীল নদের যােগযােগকারী ‘নাহরু-আমিরুল মুমেনিন’ বসরায় ‘নাহরু আবু মুসা’ প্রভৃতি খাল পানি সরবরাহ ও নৌপরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতাে। দজলা ও ফোরাত থেকে অনেক খাল খনন করে পতিত জমি আবাদযােগ্য করা হয়। হযরত ওমর (রা) এর সময়েই সেনাপতি আমর ইবনুল আস সুয়েজ খাল খনন করে লােহিত ও ভূমধ্যসাগরে নৌচলাচলের সুযােগ সৃষ্টি করেন। হযরত ওমর (রা) কুফা, বসরা, ফুসতাত, মসুল প্রভৃতি নগরীর গােড়াপত্তন করেন। তিনি বাঁধ ও খাল পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মচারীও নিয়ােগ দেন। খিলাফতের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, আইন-কানুন বাস্তবায়ন, মানুষের অভাব জানার জন্য খলিফা নিজে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। হজের সময় সাধারণ মানুষ দুর্নীতিপরায়ন কর্মচারীর বিরুদ্ধে খলিফার কাছে অভিযােগ করার সুযােগ পেত। জনসাধারণের কল্যাণই ছিল হযরত ওমর (রা) এর প্রবর্তিত শাসনের মূল লক্ষ্য।
মূলত হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামলে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রের অনুরূপ। তিনি সর্বদা প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের কাজের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। হযরত ওমর (রা) এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ সময় কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি শক্তিশালী প্রাদেশিক শাসন কাঠামো গড়ে উঠেছিল।