হযরত ওমর (রা) এর কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ও বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা ।

হযরত ওমর (রা) এর কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা।
The Central Administration of Hazrat Umar (R)

হযরত আবু বকর (রা) এর মাধ্যমে খেলাফতের যাত্রা শুরু হলেও হযরত ওমর (রা) ছিলেন ইসলামি শাসনব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিষ্ঠিতা। তিনি বিজিত অঞ্চলে বিরাজমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থার কথা চিন্তা করে প্রশাসনকে সুষ্ঠু, সুসংহত ও মানুষের কল্যাণের উপযােগী করে গড়ে তােলেন। ঐতিহাসিক সৈয়দ আমীর আলী বলেন ত্রিশ বছরের খিলাফত আমলে ওমরের জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর রাষ্ট্রনীতি ও কৌশল প্রধানত তার থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। হযরত ওমর (রা) তার দশ বছর শাসনকালে কুরআন ও সুন্নাহর আলােকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সবার সমান সুযোগ সৃষ্টি ও সমমর্যাদা দান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে হযরত ওমর (রা) সমগ্রবিশ্বে কল্যাণধর্মী শাসনব্যবস্থার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। হযরত ওমর (রা) এর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিভাগগুলাে হলাে—

মজলিস-উস-শুরা :
শুরা’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ‘পরামর্শ’। প্রাক ইসলামি যুগের দারুন নাদওয়ায় বয়োজ্যেষ্ঠ পরিষদ-এর অনুকরণে রাসুল (স) এই পরামর্শব্যবস্থা চালু রাখেন। হযরত আবু বকর (রা)-এর সময়কালেও এ ব্যবস্থা চালু ছিল। হযরত ওমর (রা) এ ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কারণ তিনি সবসময় বলতেন ‘পরামর্শ ছাড়া খিলাফত চলতে পারে না। এ গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি জনগণের সুযােগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং স্বচ্ছভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রণাপরিষদ গঠন করেন, যা মজলিসে-শুরা বা মন্ত্রণাপরিষদ নামে পরিচিত। এটি দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:
ক. মজলিস আল-খাস এবং খ. মজলিস আল-আম ।

মজলিস আল-খাস :
মজলিস আল-খাস ছিল উচ্চ পরিষদ। এটাকে Cabinet বলা হয়। এ পরিষদের সদস্য ছিলেন হযরত ওসমান (রা), হযরত আলী (রা), তালহা (রা), যুবায়ের (রা), আবদুর রহমান বিন আউফ প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবিরা। মদিনা মসজিদে এ মন্ত্রণাপরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হতাে। মজলিস আল-খাসের পরামর্শ ছাড়া ওমর (রা) কোনাে কাজ সম্পাদন করতেন না। এ পরিষদ রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যকলাপের ব্যাপারে পরামর্শ দিত। খলিফা মজলিস আল-খাসের পরামর্শক্রমে প্রশাসনে কর্মচারী, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, বিচারক নিয়ােগ দিতেন। এটি ছিল রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।

See also  জিজিয়া কী? ইসলামি রাষ্ট্রে জিজিয়া কেন প্রবর্তন করা হয়েছে?

মজলিস আল-আম:
মজলিস আল-আমের সদস্য ছিলেন প্রাদেশিক শাসক, মদিনার গণ্যমান্য ব্যক্তি, মােহাজের ও আনসাররা। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মজলিস আল-আমের বৈঠক ডাকা হতাে এবং সেখানে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতাে।

সামরিক বিভাগ :
হযরত ওমর (রা) তার শাসনামলে একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গঠন করেন। তিনি এ লক্ষ্যে সমগ্র সাম্রাজ্যকে নয়টি জুনদ বা সামরিক জেলায় (Military Districts) ভাগ করেন। জুনদগুলাে হলাে: ১. মক্কা, ২. মদিনা, ৩, কুফা, ৪. বসরা, ৫. ফুসতাত, ৬. মসুল, ৭. মিসর, ৮. দামেস্ক, ৯. হিমস ও প্যালেস্টাইন। প্রত্যেক ঘাঁটিতে ৪০০০ (চার হাজার) অশ্বসহ ৩৬০০০ অশ্বারােহী সৈন্য সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুুত থাকত।

সৈনিকদের শ্রেণিবিভাগ :
সেনাবাহিনীতে প্রধানত পদাতিক, অশ্বারােহী, তীরন্দাজ, বাহক, সেবক প্রভৃতি বিভাগ ছিল । সৈনিকেরা নিয়মিত ও অনিয়মিত এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। নিয়মিত সৈন্যরা সেনা ছাউনিতে (ব্যারাক) অবস্থান করত এবং নিয়মিত বেতন পেত। অনিয়মিত সৈন্যরা প্রয়ােজনে রাষ্ট্রের আহ্বানে যুদ্ধে যেত। তারা নিয়মিত বেতন পেতো না। সেনাবাহিনীতে প্রতি দশজন সৈন্যের নেতৃত্বদানের জন্য একজন আমির উল আশরাফ, প্রতি দশজন আমিরুল আশরাফের (একশতজন সৈন্য) ওপর একজন ‘কায়েত’ নিযুক্ত থাকত। প্রতি দশজন কায়েতের নেতৃত্বে থাকতেন এক আমির। একশতজন সৈজন সৈন্যের আমির। ‘আহরা’ নামে একটি সংস্থা সেনাবাহিনীর রসদ সংগ্রহ করত।

সৈনিকদের সুযােগ-সুবিধা :
নিয়মিত সৈন্যদের বেতন ছিল আকর্ষণীয়। প্রথমদিকে তাদের বাৎসরিক ২০০ (দুইশত) দিরহাম বেতন দেওয়া হতাে। পরে তা ৩০০ (তিনশত) দিরহামে উন্নীত করা হয়েছিল। বেতন ছাড়াও সৈনিকগণ গনিমতের অংশ, খাদ্য, বস্ত্র ও পারিবারিক ভাতা পেত। সর্ব সাকুল্যে একজন সৈন্য বছরে ৬০০০ (ছয় হাজার) এবং অফিসাররা ৭০০০-১০,০০০ (সাত হাজার থেকে দশ হাজার) দিরহাম বেতন হিসেবে পেতেন।

পুলিশ বা শান্তিরক্ষী বিভাগ ;
প্রজাসাধারণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দমন এবং সাম্রাজ্যে শান্তি
প্রতিষ্ঠার জন্য হযরত ওমর (রা) সর্বপ্রথম একটি সুসংগঠিত পুলিশ বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনীর কাজ ছিল চুরি,ডাকাতি, মাদকদ্রব্য বিক্রয় বন্ধ করা, ওজন পরীক্ষা ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা প্রভৃতি। পুলিশ বাহিনীর প্রধান ছিলেন ‘সাহিব-উল-আহদাস।’ খলিফা ৪০০০ (চার হাজার) দিরহামের বিনিময়ে সাফওয়ান বিন
উমাইয়ার বাড়ি ক্রয় করে সেটিকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করেন।

See also  প্রথম খলিফা: ওমর রা. আবু বকর রা. কে প্রথম খলিফা নির্বাচিত করতে চাইলেন।

রাজস্ব বিভাগ :
হযরত ওমরের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের একটি অন্যতম দফতর ছিল রাজস্ব বিভাগ। তিনি রাসুল (স) এবং হযরত আবু বকরের (রা) সময়কার রাষ্ট্রীয় রাজস্বের উৎস যেমন- আল গনিমত, আল জাকাত, আল উসর, আল জিজিয়া, আল খারাজ, আল উশর, আল ফাই, আল হিসার মতাে উৎসগুলােকে বজায় রাখেন। তিনি এসব উৎস থেকে আয়কৃত অর্থ বায়তুল মালের মাধ্যমে জনকল্যাণে ব্যয় করেন। ওমর (রা) এই রাজস্ব ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে ‘দিওয়ান’ গড়ে উঠেছিল।

বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা :
বায়তুল মাল হলাে ইসলামের অর্থ-সংক্রান্ত একটি প্রতিষ্ঠান। এটি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সরকারি কোষাগার। বায়তুল মাল একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ ধনসম্পদের ঘর । কিন্তুু ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ইসলামি রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অর্থ তহবিল বা জাতীয় কোষাগারকে বায়তুল মাল বলা হয় । মুলত হযরত আবু বকর (রা)-এর সময়ে বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠিত হলেও তার মৃত্যুর সময় এতে মাত্র এক দিরহাম সঞ্চিত ছিল। খলিফা ওমর (রা) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে ওয়ালিদ বিন হিশামের পরামর্শে আব্দুল্লাহ বিন আকরামকে কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করে বায়তুল মালের সংস্কার ও পুনর্গঠন করেন। কেন্দ্রের আলােকে প্রদেশে বায়তুল মালের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বায়তুল মাল ছিল প্রধানত তিন প্রকার ।

ক. বায়তুল মাল আল খাস :
এটি ছিল শাসক ও অভিজাতদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি । এ অর্থকড়ি আল ফাই এর আয়, জরিমানা প্রভৃতি থেকে আয় হতাে এবং খলিফার পরিবারের ভরণপােষণ, ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহ, রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর ব্যয় নির্বাহসহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় করা হতাে।

খ. বায়তুল মাল আল আস :
এটি খিলাফতের রাষ্ট্রীয় বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। মুসলমান ও আহলে জিম্মার সম্পদ এখানে গচ্ছিত থাকত। জাকাত ছাড়া অন্য সব উৎসের আয় এখানে জমা হতাে। এর কেন্দ্রীয় প্রধান ছিলেন সাহিব আল মাখজুম’ এবং প্রাদেশিক প্রধান ছিলেন ‘খাজিন’।

See also  সিদ্দিক উপাধি : আবু বকরকে রাসুল (স) সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত করেন কেন?

গ. বায়তুল মাল আল মুসলেমিন :
ইসলামি রাষ্ট্রের তৃতীয় রাজকোষাগার ছিল বায়তুল মাল আল মুসলেমিন । এস. এম. ইমামুদ্দিন বলেন, এটি ছিল সব মুসলমানের রাজ কোষাগার। বায়তুল মালের এ শাখা সমাজকল্যাণমূলক কাজ যেমন- রাস্তাঘাট, সেতু, মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ, এতিম ও দরিদ্রদের সাহায্যদান ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত । অধ্যাপক এম. এ. মান্নান বলেন, এটি থেকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য প্রদান করা হতাে। বায়তুল মালের এ শাখাটি মসজিদ-ই-জামিতে সংরক্ষণ করা হতাে । প্রদেশে ‘কাজি’ ছিলেন এর প্রধান এবং কেন্দ্রীয় স্তরে ‘কাজি-উল-কুজ্জাত’ ছিলেন প্রধান।

1 thought on “হযরত ওমর (রা) এর কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ও বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা ।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *