গজনীর সুলতান মাহমুদ এর (৯৯৭-১০৩০) প্রাথমিক জীবন ও সিংহাসনে আরোহণ:
গজনীর অধিপতি সবুক্তগনী কতৃর্ক ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে গজনবী বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। সবুক্তগীনের পুত্র মাহমুদ ৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি যুদ্ধবিদ্যা, শাসন পদ্ধতি এবং রাজনীতিবিদ্যা সম্পর্কে যথেষ্ট শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। পিতার মৃত্যুর পর স্বীয় ভ্রাতা ইসমাইলকে পরাজিত ও কারারুদ্ধ করে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ২৬ বছর বয়সে মাহমুদ গজনীর সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য :
গজনির সুলতান মাহমুদ ১০০০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ১৭ বার ভারত অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্রত্যেকটি অভিযানেই জয়লাভ করেন। কিন্তু কী কারণে ও উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ বারবার ভারত অভিযান পরিচালনা করেন, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। এখন আমরা সংক্ষেপে তাঁর ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আলোচনা করব।
ধর্মীয় উদ্দেশ্য :
কতিপয় ঐতহাসিকের ধারণা যে, পৌত্তলিকতার ধ্বংস সাধন করে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যেই সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযান করেছিলেন। তাঁদের মতে, আব্বাসীয় খলিফা কাদির বিল্লাহ সুলতান মাহমদের উপর ভারতে ইসলাম প্রচারের দায়িত্বভার ন্যস্ত করেন। এ দায়িত্ব পালনের জন্যই মাহমুদ বার বার ভারতে অভিযান চালান এবং এ উপমহাদেশে ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন। তাদের যুক্তি হল, হিন্দুদের সুবিখ্যাত নগরকোট মন্দিরসহ অসংখ্য মন্দির তার হস্তে বিধ্বস্ত হয়। কতিপয় রাজাসহ ভারতের বহু সহস্র হিন্দুকে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে আমরা উপরে উল্লিখিত মতকে সত্য বলে গ্রহণ করতে পারি না। কারণ:-
সুলতান মাহমুদ ধর্ম প্রচারক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত বিজেতা। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও তিনি অন্যের উপর কখনও জোর করে তার ধর্মমত চাপিয়ে দেন নি। তিনি একটি বিরাট হিন্দু সৈন্যদল পোষণ করতেন। এই হিন্দু সৈন্যরা মুসলমান সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করত । যদি সুলতান মাহমুদের ধর্মীয় উদ্দেশ্য থাকত তাহলে স্বধর্মীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ হিন্দুদের পক্ষে সম্ভব হত না। ধর্ম প্রচারের জন্য রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। সুলতান মাহমুদের অভিযানগুলোর পিছনে ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করার কোনো উদ্দেশ্যই নিহিত ছিল না । তাছাড়া সুলতান মাহমুদ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সহিষ্ণু। গজনিতে তিনি হিন্দুদের বসবাসের জন্য একটি পৃথক। কলোনী স্থাপন করেন এবং হিন্দু সংস্কৃতি ও স্থানীয় সাহিত্য বিকাশের জন্য তথায় একটি কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ধর্মীয় উদ্দেশ্য তাঁর ভারত অভিযানের পিছনে ছিল না ।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য :
সুলতান মাহামুদ মধ্য-এশিয়ায় একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশ্যেই তাঁকে স্বীয় সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার প্রয়োজনে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কিছু অংশ এবং পাঞ্জাবের অন্তর্ভূক্তি অপরিহার্য ছিল। ঐসব অঞ্চলে অধিকার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতোপূর্বে তাঁর পিতা সবুক্তগীন ও জয়পালের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পিতা কতৃক সমস্যাটির চুড়ান্ত সমাধান না হওয়ায় সুলতান মাহমুদ পাঞ্জাব ও মুলতানকে স্বীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করে শক্তিশালী গজনি সাম্রাজ্য গঠন করেন। পরবর্তীকালে তার এ ব্যবস্থা বানচাল করতে যে সব হিন্দু রাজা সক্রিয় ও তৎপর ছিলেন তাদেরকে এবং সন্ধির শর্তভঙ্গকারী, বিশাসঘাতক ও শত্রপক্ষকে সাহায্যদানকারী শাসকগণকে শাস্তিদানের উদ্দেশ্যেই সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযান পরিচালনা করেন।
অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য:
ভারত ছিল ধনসম্পদে সমৃদ্ধ একটি বিরল দেশ। গজনির শাসন ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা, একটি বিরাট সেনাবাহিনী পোষণ ও তাদেরকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ প্রদান করা এবং গজনিকে সমগ্র বিশ্বে একটি সমৃদ্ধশালী ও সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত করার জন্য সুলতান মাহমুদের প্রচর অর্থের প্রয়োজন ছিল। তাই ভারতবর্ষের অফুরন্ত ধন-সম্পদ তাকে প্রলুদ্ধ করে। ভারতবর্ষ থেকে ধনরত্ন আহরণ করেই তার এসব মহাপরিকল্পনা বাস্তবে রূপদান করতে চেয়েছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষ অভিযানে উদ্বুদ্ধ হন। আরও স্পষ্ট করে বলা যায় যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভারতবর্ষের নৃপতিদেরকে দুর্বল করে রেখেই সুলতান মাহমুদ মধ্য এশিয়াই একটি নির্বিঘ্ন ও নিষ্কন্টক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিলেন।
সুলতান মাহমুদের প্রধান অভিযানসমূহ:
সুলতান মাহমুদ ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী ও উদ্যমী। বাগদাদের খলিফা কাদির বিল্লাহর নিকট হতে স্বীয় সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায়ের পর তিনি ১০০০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন। তাঁর অভিযানগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো :
১. ভারতবর্ষে সুলতান মাহমুদ ১০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম অভিযান পরিচালিত করে খায়বার গিরিপথে অবস্থিত ভারতের কতিপয় সীমান্ত নগরী এবং দুর্গ অধিকার করেন।
২. ১০০১ খ্রিস্টাব্দে ১০,০০০ সেনাবাহিনী নিয়ে সুলতান মাহমুদ পাঞ্জাবের রাজা জয়পালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। পেশোয়ারের নিকট উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে জয়পাল পরাজিত এবং অনুচরবর্গসহ বন্দী হন। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ প্রদান করে জয়পাল মুক্তিলাভ করলেও অপমানে ও ক্ষোভে পুত্র আনন্দ পালের উপর রাজ্যের শাসনভার অর্পণ করে। অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
৩. সুলতান মাহমুদ ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে ভীরার রাজ্য বিজয় ও ১০০৬ খ্রিস্টাব্দে মুলতানের শাসনকর্তা আবুল ফাতাহ এর বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করে জয় লাভ করেন।
৪. ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাঞ্জাবের শাসনকর্তা আনন্দ পালের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। আনন্দপাল তাকে বাধা দেবার জন্য এক বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করে অগ্রসর হন। উন্দ নামক স্থানে উভয়ের মধ্যে এক ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এ যুদ্ধে মাহমুদ জয়ী হন এবং প্রচুর ধনসম্পদ মাহমুদের হস্তগত হয়।
৫. ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ কাংড়া পাথরের নগর কোট দূর্গ দখল ও ১০১০ খ্রিস্টাব্দে মুলতানের বিদ্রোহী শাসনকর্তা দাউদকে পরাজিত করেন।
৬.
১০১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আনন্দপালের পুত্র তিলোচন পালের বিরুদ্ধে সহজ অভিযান পরিচালনা করে তাকে পরাজিত করে রাজধানী নন্দনা অধিকার করেন, একই বছর সুলতান থানেশ্বরের বিরুদ্ধেও অভিযান প্রেরণ করে সহজে জয়লাভ করেন।
৭. ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ হিন্দুস্থানী সাম্রাজ্যের রাজধানী কনৌজের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করে ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে কনৌজের ফটকের সম্মুখে উপনীত হন। কনৌজের প্রতিহারে রাজ্যপাল ভীত হয়ে বিনাশর্তে সুলতান মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করেন। এতে প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে কালিঞ্জরের চান্দেলী রাজা গোল্ডার নেতৃত্বে রাজ্যপালকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। সুলতান মাহমুদ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে চান্দেলা রাজ্যের
বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাকে পরাজিত করেন।
৮. ১০২১-২২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গোয়ালিয়র ও ১০২৩ খ্রিস্টাব্দে গোল্ডার দুর্গ অনায়াসে অধিকার করেনেন।
৯. সোমনাথ বিজয় সুলতান মাহমুদের সাধ্যের বাইরে বলে পুরোহিতগণ আস্ফালন করলে সুলতান মাহমুদ এক বিরাট ও শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী নিয়ে ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ই জানুয়ারি সোমনাথের দ্বারে এসে উপনীত হন। হিন্দু রাজন্যবর্গ তার গতিরোধকল্পে সংঘবদ্ধ হয়ে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হন। কিন্তু মুসলিম সেনাবাহিনীর অমিত বিক্রম, সাহস, তেজস্বী, যুদ্ধস্পৃহা ও রণকৌশলের নিকট হিন্দু সৈন্যগণ পরাজিত হয়। সুলতান মাহমুদ হিন্দুদের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অফুরন্ত ধন-রত্ন হস্তগত করেন।
১০. সোমনাথ অভিযান হতে প্রত্যাবর্তন কালে মুসলিম সৈন্যগণ জাঠদের দ্বারা উৎপীড়িত হয়েছিল বলে সুলতান মাহমুদ তাদের বিরুদ্ধে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে সপ্তদশ ও শেষ অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। যুদ্ধে জাঠগণ পরাজিত হলে তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল:
সুলতান মাহমুদ তার বিজয়াভিযানসমূহ দ্বারা উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর আর্থিক বুনিয়াদ ধ্বংস করেন এবং অগণিত ধনরত্ন ও ঐশ্বর্য-বৈভব লাভ করেন। তা দ্বারা স্বীয় গজনি সাম্রাজ্যকে সৃমন্বিশীল ও গৌরবান্বিত করে গড়ে তোলেন। সুলতানের যুদ্ধ ও শান্তিকালীন মহাপরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নে ভারতের সম্পদ তাকে সহায়তা দান করায় তিনি দ্রুত সাফল্য লাভে সমর্থ হন।
সুলতান মাহমুদের আক্রমনের ফলে মুসলিম যোদ্ধাদের সাথে স্বেচ্ছায় অনেক পীর-দরবেশও ভারতে আসেন এবং ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন। ফলে ক্রমান্বয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য লোক ইসলাম গ্রহণ করে।
সুলতান মাহমুদের অভিযানের ফলে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান এবং সমঝোতা সুগম হয় এবং উভয়ের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক নবযুগের সূত্রপাত হয়। তিনি শুধুমাত্র পাঞ্জাবেই স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেখান হতে হিন্দু রাজাদের রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতা লক্ষ্য করার সুযোগ লাভ করে। এটা পরবর্তীকালে মুসলমানগণ কর্তৃক ভারত বিজয়ের পথকে সহজসাধ্য করে তোলে ।
সুলতান মাহমুদের সাফল্যের কারণ:
সুলতান মাহমুদ একজন সুদক্ষ সেনা নায়ক ও প্রখ্যাত বিজেতা ছিলেন। সমর কুশলতা ও সামরিক মেধায় সেই যুগে কোনো নৃপতিই তার সমকক্ষ ছিলেন না। কঠোর অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার দ্বারা তিনি একটি সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তাই হিন্দু বাহিনী মুসলমানদের অপেক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অনৈক্য অসাম্য ও অরাজকতা তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়। যা মাহমুদের বিজয়ে সহায়ক হয়েছিল । তাছাড়া সকল যুদ্ধ সুলতান মাহমুদের স্বয়ং উপস্থিতি মুসলিম সৈন্যদের মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার করত । ফলে তাদের বিজয়লাভ সহজতর হয় । একদিকে জেহাদের মর্মবাণী ও ধর্মীয় পুন্যলাভের প্রেরণা এবং অপরদিকে যুদ্ধলব্ধ দ্রব্য-সামগ্রী লাভের আকাঙ্খা মুসলিম সেনাবাহিনীকে মৃত্যুভয় তুচ্ছ জ্ঞান করে নেতার আদেশ পালনে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল এবং শত্রুর বিরুদ্ধে অজেয় করে তোলে।
সুলতান মাহমুদের চরিত্র:
সুলতান মাহমুদ সাহসী, ধৈর্যশীল ও নীতিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তার চরিত্রে উচ্চাভিলাষ ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। শাসক হিসাবে তিনি প্রজাদের প্রতি দয়ালু ও সুবিচেক ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রগাঢ় ধর্মনিষ্ঠ, আত্মপ্রত্যয়ী, অধ্যবসায়ী, কর্তব্যপরায়ন ও পর ধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন । হিন্দুদেরকে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে ধর্মকর্ম করার অনুমতি দান করেন এবং বসবাসের জন্য নগরীতে আলাদা এলাকার ব্যবস্থা করেন। মানব সমাজের এই মহান নেতা ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে ৬০ বছর বয়সে গজনিতে পরলোক গমন করেন ।
সুলতান মাহমুদের উত্তরাধিকারীগণ:
সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র মাসূদ এবং মুহাম্মদের মধ্যে উত্তরাধিকার স্বত্ব নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে মাসুদ জয়ী হয়ে ভ্রাতা মুহাম্মদকে অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করেন। মাসুদ ছিলেন উদার ও সাহসী। তবে তিনি সেলজুক ও তুর্কি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন নি এবং মার্ভের নিকট যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হন। সৈন্যবাহিনী তার অন্ধ ভ্রাতা মুহম্মদকে সিংহাসনে বসাল। পরে মুহম্মদ তার পুত্র আহমেদকে শাসনভার অর্পণ করলে সে মাসুদকে কারাগারে হত্যা করে। এদিকে মাসুদের পুত্র মওদুদ ক্ষীপ্ত হয়ে মুহম্মদের সমগ্র পরিবারের বিনাস সাধন করেন। নয় বছর রাজত্ব করার পর মওদুদ মৃত্যুমুখে পতিত হলে কয়েকজন দুর্বল শাসক গজনীর সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। কিন্তু তারা কেউই সেলজুকদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন নি। এই বংশের শেষ সুলতান ছিলেন খসরু মালিক। তিনি ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরীর নিকট পরাজিত হন।
গজনী বংশের পতনের কারণসমূহ:
প্রথমত :
গজনি বংশের পরবর্তীকালের কোন শাসকই সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে রাজ্যের সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। কাজেই জনসমর্থনের অভাবে গজনী বংশের পতন ঘটে।
দ্বিতীয়ত,
ভারতীয় উপমহাদেশ হতে আহরিত অগণিত ধন-রত্ন সুলতান মাহমুদের উত্তরাধিকারিগণকে আরামপ্রিয় ও বিলাসী করে তোলে। ফলে তারা শত্রুর আক্রমণ হতে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে ।
তৃতীয়ত :
হত্যা, ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিভিন্ন দলের মধ্যে পরস্পর স্বার্থ সংঘাত সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল দুর্বল করে। ফলে তাদের পতন ঘটে।
মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরী তাঁর ভারত অভিযান ও প্রথম ও দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধ:
আফগানিস্তানের অন্তর্গত হেরাত ও গজনির মধ্যবর্তী পার্বত্যাঞ্চলে ঘুর রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। দশম শতাব্দীতে এটি একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। কিন্তু ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে ঘুররাজ মুহাম্মদ বিন সুরকীকে পরাজিত করে সুলতান মাহমুদ ঘুর রাজ্যটি অধিকার করেন। সুলতান মাহমদের দুর্বল ও অযোগ্য উত্তরাধিকারিগণের সুযোগে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ বিন সাম যিনি ইতিহাসে শিহাবউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরী নামে পরিচিত, তিনি ঘুর রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তৃতীয় পর্যায়ে অভিযান পিরচালনা করে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রথম স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গৌরব অর্জন করেন।