দিউয়ান : হযরত ওমর (রা) এর দিউয়ান ও রাজস্ব প্রশাসন।
Diwan and Revenue Administration of Hazrat Umar (R)
হযরত ওমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা পারস্য ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে বিস্তৃত হলে ওই অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ রাজস্ব হিসেবে কেন্দ্রীয় কোষাগার বা বায়তুল মালে জমা হতে থাকে। খলিফা এ অর্থ দিয়ে প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্ত অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতেন। হযরত ওমর (রা) এর গঠিত দিউয়ান উল খারাজ বিভাগটি এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।
দিউয়ান উল খারাজ প্রতিষ্ঠা:
‘খারাজ’ আরবি শব্দ। এ শব্দটি গ্রিক Khoregin শব্দ থেকে সিরীয় ভাষার মাধ্যমে আরবি ভাষায় এসেছে। এর অর্থ যা বের হয়ে গেছে। যেহেতু জমির কর ভূমির মূল উৎপাদন থেকে বের হয়ে যায় তাই একে খারাজ বলে। হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামলে খিলাফতের সম্প্রসারণের ফলে বিজিত এলাকাগুলােতে ভূমিকর হিসেবে প্রাপ্ত খারাজের হিসাব-নিকাশ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি ‘দিউয়ান-উল-খারাজ’ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিভাগের কাজ ছিল খারাজের খাত থেকে আয়কৃত অর্থের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ এবং দাপ্তরিক ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্ত অর্থ মুসলিমদের মাঝে বণ্টন। এ লক্ষ্যে হযরত ওমর (রা) প্রথম আদমশুমারির লােক গণনা ব্যবস্থা করেন এবং একটি তালিকা প্রণয়ন করে নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ফলে হযরত ওমরের (রা) এ দপ্তরটি মুসলমানদের আশা –
রাজস্বের উৎসসমূহ
জাকাত:
জাকাত ইসলামি অর্থনীতির প্রধান উৎস। এটি পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মুসলমানদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক কর। নিসাব পরিমাণ সম্পদ অর্থাৎ কোনাে ব্যক্তির কাছে যদি নিজের পরিবারের ব্যয় নির্বাহের পর বছরান্তে কমপক্ষে সাড়ে সাত তােলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তােলা রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ অর্থ থাকে, তবে উক্ত সম্পদের ২.৫% হারে আল্লাহর নির্ধারিত আটটি খাতে প্রদান করাকে জাকাত বলে। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে জাকাতের এ আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে। এগুলাে হলাে—
১. অভাবগ্রস্ত বা ফকির,
২, সম্বলহীন বা মিসকিন,
৩, যাকাত আদায়ে নিয়ােজিত কর্মচারী,
৪. মন জয় করার উদ্দেশ্যে,
৫. মুক্তিকামী দাস,
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি,
৭. আল্লাহর পথে এবং
৮ মুসাফির বা অসহায় পথিক। রাসুল (স) এর সময় যেভাবে জাকাত আদায় হতাে খলিফা ওমর (রা) সেভাবেই আদায় করতেন। তবে তার আমলে ঘােড়ার ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় তিনি এর ওপর জাকাত ধার্য করেন।
জিজিয়া :
জিজিয়া হলাে মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম প্রজাদের ওপর নির্ধারিত একটি নিরাপত্তামূলক কর। মহানবির (স) সময়ে এ করের পরিমাণ ছিল মাথাপিছু বার্ষিক এক দিনার। তিনি প্রত্যেক সামর্থ্যবান অমুসলিমের ওপর এ কর ধার্য করেছিলেন। খলিফা ওমর (রা) রাজ্যের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য এ খাত সংস্কার করেন। তিনি পারসিক ও রােমানদের আর্থিক সচ্ছলতার কথা বিবেচনা করে জিজিয়ার পরিমাণ পুনঃনির্ধারণ করেন। প্রত্যেক ধনীর ওপর চার দিনার, মধ্যবিত্তদের ওপর দুই দিনার এবং নিম্নবিত্তদের ওপর এক দিনার জিজিয়া আরােপ করা হয়। গরিব, শিশু, নারী, বিকলাঙ্গ এবং অসামর্থ্যবান পুরুষের কাছ থেকে এ কর আদায় করা হতাে না। রাষ্ট্র কোনাে জিম্মি বা অমুসলিম প্রজাদের নিরাপত্তাদানে ব্যর্থ হলে জিজিয়ার অর্থ ফেরত দেওয়া হতাে।
গনিমত;
যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের কাছে থেকে প্রাপ্ত সম্পদকে গনিমত বলা হয়। পরাজিত সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র, ঘােড়া, খাদ্যশস্য, পােশাক, দাস-দাসী, স্বর্ণ-রৌপ্য, পশু প্রভৃতি গনিমতের অন্তর্ভুক্ত। এসব সম্পদের পাঁচ ভাগের চারভাগ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতাে। অবশিষ্ট পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুল মালে জমা রাখা হতাে। এই অংশকে বলে ‘আল খুমস’। খুমুসের তিন ভাগের এক ভাগ মহানবি (স) এর পরিবারবর্গকে দেওয়া হতাে। খলিফা ওমর (রা) এ নিয়ম রদবদল করে মহানবির (স) পরিবারের অংশটুকু সৈন্যদের সাজ-সরঞ্জাম ক্রয় করার নির্দেশ দেন।
উশর :
উশর হলাে মুসলমানদের দেওয়া ভূমি রাজস্ব। এ ভূমি রাজস্ব দুই পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয় যথা- ক.বৃষ্টির পানির মাধ্যমে ভূমি চাষাবাদ হলে উৎপন্ন ফসলের ১/১০ ভাগ এবং খ.সেচের পানির মাধ্যমে চাষাবাদ করলে উৎপন্ন ফসলের ১/২০ ভাগ উশর হিসেবে আদায় করা হতো।
উশুর;
উশুর হলাে বাণিজ্য শুল্ক বা কর । খলিফা ওমর (রা) সর্বপ্রথম বাণিজ্য শুল্ক ধার্য করেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিদেশি বণিকেরা কোনাে প্রকার বাণিজ্য কর দিত না। কিন্তু যেসব মুসলিম ব্যবসায়ী পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সাথে বাণিজ্য করে তাদেরকে পণ্যদ্রব্যের ওপর শতকরা ১/১০ ভাগ কর দিতে হতাে। খলিফা ওমর এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করে। মুসলমান বণিকদের ওপর ২.৫%, জিম্মি (মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম প্রজা) বণিকদের ওপর ৫% এবং বিদেশি বণিকদের ওপর ১০% শুল্ক আরােপ করেন।
আল ফাই:
আল ফাই হলাে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন খাস ভূমি । দেশ বিজয়ের পর যেসব পলাতক শত্রুর ভূমি, বিদ্রোহীদের বাজেয়াপ্ত করা জমি, বনভূমি, গােচারণক্ষেত্র, বেওয়ারিশ জমি পাওয়া যেত সেগুলাে সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন না করে সরকারের দখলে নেওয়া হতাে। এসব ভূ-সম্পদ আল ফাই হিসেবে পরিচিত ছিল। এসব ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসলের অর্থ রাষ্ট্র পেত।
আল হিমা:
আল হিমা হলাে পশুচারণক্ষেত্রে আরােপিত কর । খলিফা ওমর (রা) চারণভূমি হিসেবে বিশাল এলাকা খাস করে দেন। রাষ্ট্রীয় চারণভূমিতে পশুচারণের জন্য কর আলােপ করা হয়। এসব চারণভূমিতে সরকারি পশুর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ।
খারাজ :
ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম প্রজা বা জিম্মিদের চাষাবাদের জমিকে বলা হয় খারাজি ভূমি। আর খলিফা বা ইসলামি রাষ্ট্রের শাসক এই ভূমির ওপর যে কর আদায় করেন তাকে বলা হয় “খারাজ’ । এস.এম. ইমামুদ্দিন বলেন, খারাজ হচ্ছে সেই ভূমিকর যা অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময় রাজস্ব আদায়ের অন্যতম উৎস ছিল খারাজ। ভূমিরাজস্ব বিভাগের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য ওমর (রা) ‘দিউয়ান উল-খারাজ’ নামে গঠিত নতুন রাজস্ব বিভাগ রাজস্বের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করত। সুষ্ঠুভাবে খারাজ আদায়ের জন্য খলিফা ওমর ৩০ হাজার বর্গমাইল এলাকায় ৩৬,০০,০০০ জারিব আবাদি ভূমি রেকর্ড করেন। (ঐতিহাসিক বালাজুরির মতে, ১ জারিব = ৩৬৮০ বর্গগজ, লেভির মতে, ৬০x৬০ = ৩৬০০ বর্গফুট)। তিনি ভূমির উৎপাদন শক্তির ওপর ভিত্তি করে খারাজের হার নির্ধারণ করেন।
দিউয়ান-এর ব্যয়ের খাত :
রাষ্ট্রের আয়ের বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত রাজস্বগুলাে হযরত ওমর (রা) দিওয়ানের মাধ্যমে নিম্নোক্তভাবে ব্যয়ের সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরি করেছিলেন। দিউয়ানের ব্যয়ের খাতগুলাে হচ্ছে-
১. গরিব, দুঃখী, আদায়কারী, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্তের ঋণমােচন, আল্লাহর পথের পথিক এবং মুসাফিরদের সাহায্যদান,
২. অসামরিক খাতের ব্যয়ভার নির্বাহ,
৩. সামরিক বিভাগের ব্যয়ভার নির্বাহ,
৪. অনাথ, বেওয়ারিশ শিশুর লালন-পালন,
৫, দুস্থদের ভাতা প্রদান এবং
৬. বিভিন্ন জনহিতকর কাজ সম্পাদন।
ভাতার তালিকা প্রস্তুতকরণ ;
হযরত ওমর (রা)-এর সময় দিউয়ান উল খারাজ বিভাগ একটি ভাতাভােগী তালিকা প্রস্তুুত করে। এ তালিকা তৈরি করার জন্য আদমশুমারি পরিচালনা করা হয়। সামরিক ও বেসামরিক খাতে রাজকর্মচারীদের বেতন এবং জনহিতকর কাজে ব্যয় করার পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকত তা সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া
হতাে। দিউয়ানের মাধ্যমে এ বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। এম আই মুসা বলেন, Urmar established the Diwan for persons and department the amounts to be distributed to the recipients according to their descent seniority in Islam or relationship to the Prophet’.” প্রত্যেক মুসলমানের ভাতার পরিমাণ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করত। যথা: ক, মহানবি (স) এর আত্মীয়স্বজন, খ. ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমান এবং গ, ইসলামের সাহায্যকারী। হযরত ওমরের সময়ে দিউয়ানের মাধ্যমে প্রদত্ত ভাতার একটি তালিকা নিম্নরূপ:
ভাতাভােগী শ্রেণি ও ভাতার পরিমাণ
১. মুহাজির ও আনসার (যারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন) ৫,০০০ দিরহাম |
২. মুহাজির ও আনসার (যারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি) ৪,০০০ দিরহাম
৩. রাসুলের (স) স্ত্রী (বিবি আয়েশা ব্যতীত) ১০,০০০ দিরহাম |
৪. হযরত আয়েশা (রা)। ১২,০০০ দিরহাম
৫. মুহাজির ও আনসারদের পুত্র। ২,০০০ দিরহাম |
৬, মুহাজির ও আনসারদের স্ত্রী ২০০-৬০০ দিরহাম |
৭. রাসুলের (স) চাচা আব্বাস ১০,০০০ দিরহাম |
৮. হাসান ও হুসেইন ৫,০০০ দিরহাম
৯. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ৩,০০০ দিরহাম
১০. মক্কার অধিবাসী ৮০০ দিরহাম |
১১. মদিনার অধিবাসী ৩০০-৫০০ দিরহাম |
১২. গভর্নর ৬০০ দিরহাম।
১৩. শিশু (বালেগ হওয়া পর্যন্ত) ১০০ দিরহাম
বাৎসরিক এ ভাতার সাথে প্রত্যেকে প্রতি মাসে ২ জারিব শস্য পেত। আল মাওয়ার্দীর (আল আহকামুস সুলতানীয়া) মতে, “হযরত ওমর (রা) আরব ও অনারব সকলের ক্ষেত্রে ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন।” ঐতিহাসিক ডব্লিউ মুর বলেন, “ওমরের ভাতা ব্যবস্থা ছিল জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী যা সম্ভবত তৎকালীন বিশ্বে কোথাও ছিল না।”
ভূমি জরিপের ব্যবস্থা:
খলিফা ওমর (রা) বিজিত এলাকায় ভূমি জরিপ করে জমির উর্বরা শক্তির ওপর ভিত্তি করে কর নির্ধারণ করেন। শুধু ইরাকেই চাষযােগ্য ভূমির পরিমাণ ছিল ৩৬,০০,০০,০০০ জারিব (লােহার বলয় দ্বারা বেষ্টিত শত দণ্ড, যা দিয়ে জমি মাপা হতাে)। প্রতি জারিব জমিতে বাৎসরিক কর নির্ধারিত হতাে গমে ২ দিরহাম, বার্লি ১, আখ ৬, তুলা ৫, আঙুর ১০, খেজুর ১০ ও তিল জাতীয় দ্রব্য ৮ দিরহাম।
ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেন, “আরব জাতির মতাে ভ্রাতৃত্ব, সমতার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ রাজস্ব, গনিমত এবং বিজিত স্থানসমূহের বণ্টনপ্রথা সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ওমর রাঃ এর দিওয়ান কি
ওমর রাঃ ছিলেন প্রফেট হাজরাত মুহাম্মদ এর শশুরমশাই। তিনি দ্বিতীয় রাশিদুন খলিফা এবং প্রথম মুসলমান যিনি কাবা তে নামাজ পড়েছিলেন। তাকে ইসলাম সমাজে আল-ফারুক ও বলা হয়।
দিওয়ান এর প্রতিষ্ঠাতা কে
দিয়ানের আসল প্রতিষ্টাতা কে সেটা ঠিক জানা যাই না। তবে এটার মানে আসলে দাঁড়াচ্ছে – ওরিয়েন্টাল কাউন্সিল অফ এ স্টেট, যেটা তুর্কিশ ভাষা থেকে এসেছে।
ওমর রা এর দিওয়ান কি?
ওমর রা এর দিয়ান মানে দ্বিতীয় খলিফা।
দিওয়ান বলতে কি বুঝ
দিয়ান শব্দটার মানে ইসলাম এ – একজন শাসক বা ক্ষমতা সম্পন্ন মন্ত্রী।
FAQ
Q1. ওমর রা 🙂 এর দিওয়ান কী?
Ans. ওমর রাঃ ছিলেন প্রফেট হাজরাত মুহাম্মদ এর শশুরমশাই। তিনি দ্বিতীয় রাশিদুন খলিফা।
Q2. হযরত ওমর রাঃ কি নবী ছিলেন?
Ans. হ্যা তিনি নবি ছিলেন এবং তিনি প্রথম মুসলমান যিনি কাবাতে নামাজ পড়েছেন।
Q3. দিওয়ান বলতে কি বুঝায়?
Ans.দিয়ান শব্দটার মানে ইসলাম এ – একজন শাসক বা ক্ষমতা সম্পন্ন মন্ত্রী।
Q4. কুরআনে ওমর কে ছিলেন?
Ans.ওমর হলেন প্রথম খলিফা যিনি আমির আল মুমিনীন বলে খ্যাতিলাভ করেছেন।
Q5. আবু শাহমা কে ছিলেন?
Ans. তিনি ছিলেন সেজে অফ দামাস্কাস এর প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী।