বাংলাদেশে চুক্তিপত্র প্রস্তুত করার সময় স্ট্যাম্প ব্যবহারের গুরুত্ব অনেক বেশি। যেকোনো ধরনের আইনি বা বাণিজ্যিক চুক্তি যদি স্ট্যাম্প ছাড়া করা হয়, তাহলে তা ভবিষ্যতে অকার্যকর বা আদালতে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। তাই চুক্তিপত্র স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম জানা প্রতিটি ব্যক্তি, বিশেষত যারা ব্যবসা, জমি বা আইনসংক্রান্ত কাজে জড়িত, তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
স্ট্যাম্প একটি সরকার অনুমোদিত নথি বা কাগজ, যা নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে সংগ্রহ করা হয়। এটি মূলত সরকারের রাজস্ব আদায়ের একটি মাধ্যম হলেও, আইনি দলিলকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক। স্ট্যাম্প ছাড়া একটি চুক্তিপত্র কেবল একটি অপ্রমাণিত লেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, যার ওপর কোনো পক্ষ বাধ্যতামূলকভাবে দায়বদ্ধ থাকে না।
তাই আপনি যদি জমি লেনদেন, ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব, লোন, জামানত, ভাড়া বা যেকোনো প্রকার আর্থিক বা দায়বদ্ধ সম্পর্ক স্থাপন করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে চুক্তিপত্র স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এই নিয়মগুলো শুধু আইন মেনে চলার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য অপরিহার্য।
স্ট্যাম্প ফি নির্ধারণের আইন ও রেট

বাংলাদেশে যেকোনো আইনি দলিলে স্ট্যাম্প ফি নির্ধারণ একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। এই ফি নির্ভর করে চুক্তিপত্রের ধরন, তার আর্থিক মূল্য এবং প্রকৃত উদ্দেশ্যের উপর। প্রতিটি দলিলের জন্য আলাদা রেট নির্ধারণ করে সরকার, যা প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয় বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন বা বার্ষিক বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে। ফলে যারা চুক্তিপত্র তৈরি করেন, তাদের উচিত এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য জানা এবং অনুসরণ করা।
উদাহরণস্বরূপ, সাধারণ অঙ্গীকারনামা বা পারস্পরিক চুক্তিপত্রের জন্য স্ট্যাম্প ফি সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে হয়। জমি কেনাবেচার বায়নাপত্রে ফি আরও বেশি হতে পারে—সেখানে জমির বাজারমূল্যের ওপর ভিত্তি করে স্ট্যাম্প নির্ধারিত হয়। মর্টগেজ, জামানত, কিংবা উচ্চমূল্যের অংশীদারিত্ব চুক্তিতে ২% পর্যন্ত স্ট্যাম্প ফি নির্ধারিত হতে পারে, যার অর্থ এক কোটি টাকার চুক্তিতে স্ট্যাম্প খরচ হতে পারে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া কিছু বিশেষ ধরনের চুক্তিপত্র যেমন পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি, ভাড়ার চুক্তি বা স্থায়ী ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব দলিলে আলাদা ফি কাঠামো রয়েছে। নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার এসব চুক্তিতে বাধ্যতামূলক, এবং ভুল রেটে স্ট্যাম্প ব্যবহারের ফলে দলিল বাতিল বা অকার্যকরও হয়ে যেতে পারে।
এই জন্য আপনাকে অবশ্যই সময়মতো বর্তমান সরকার নির্ধারিত ফি তালিকা বুঝে নিতে হবে। আইনজীবী বা নোটারি পাবলিকের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে যাতে চুক্তিপত্র তৈরির সময় ভুল না হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অতিরিক্ত বা কম স্ট্যাম্প ব্যবহারের কারণে পরবর্তীতে আইনি জটিলতা দেখা দেয়, বিশেষত যখন দলিলটি আদালতে যাচাই করা হয়।
আপনি যদি সঠিকভাবে চুক্তিপত্র স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম অনুসরণ করতে চান, তাহলে অবশ্যই চুক্তির প্রকৃতি এবং আর্থিক মূল্য বুঝে সুনির্দিষ্ট স্ট্যাম্প ফি বসাতে হবে।
চুক্তিপত্রে স্ট্যাম্প লেখার সঠিক পদ্ধতি

চুক্তিপত্রে সঠিকভাবে স্ট্যাম্প লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা দলিলের বৈধতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে। অনেকে শুধু স্ট্যাম্প লাগিয়ে ভাবেন কাজ শেষ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি পদ্ধতিগত বিষয়। চুক্তিপত্র স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম অনুসরণ না করলে, দলিল আইনত বাতিলও হতে পারে বা গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে।
সঠিক স্ট্যাম্প কেমন হওয়া উচিত?
প্রথমত, ব্যবহৃত স্ট্যাম্প অবশ্যই সরকারি অনুমোদিত ও নির্ধারিত মূল্যমানের হতে হবে। বর্তমানে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কাগজ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকায় পাওয়া যায় যেমন ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ বা ২০০০ টাকার। আপনার চুক্তির ধরন ও অর্থের পরিমাণ অনুযায়ী সঠিক মানের স্ট্যাম্প ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। কোনও পুরাতন, ছেঁড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ স্ট্যাম্প ব্যবহার করা যাবে না।
স্ট্যাম্পে কী লেখা উচিত?
স্ট্যাম্পে সাধারণত চুক্তির তারিখ, দলিলের নাম, চুক্তির ধরণ এবং টাকার পরিমাণ লিখে তা সিলমোহর করা হয়। এছাড়া চুক্তির উভয় পক্ষের নাম, ঠিকানা ও স্বাক্ষর সন্নিবেশ করতে হয়। অনেক সময় চুক্তিতে সাক্ষীর নাম ও স্বাক্ষর যুক্ত করাও বাধ্যতামূলক হয়—বিশেষ করে যদি তা জমি বা সম্পত্তি সংক্রান্ত হয়।
স্ট্যাম্প বসানোর সময় যেসব সাবধানতা জরুরি
স্ট্যাম্প বসানোর সময় একটি বড় ভুল হচ্ছে সেটি কাগজের ভুল অংশে বসানো। সাধারণত স্ট্যাম্প কাগজের উপরের দিকে বা নির্ধারিত স্থানে বসানো হয়, যাতে তা সহজে চোখে পড়ে ও প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হয়। স্ট্যাম্প সঠিকভাবে সিলমোহর না করলে তা বাতিল হতে পারে। এ ছাড়া স্ট্যাম্প এমন জায়গায় বসানো উচিত নয়, যেখানে তা সহজে ছিঁড়ে যেতে পারে বা বাতাসে উড়ে যেতে পারে।
এছাড়া স্ট্যাম্পে কালি ঝাপটা, অস্বচ্ছ লেখা বা অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ এড়ানো উচিত। এটি সরকারি নথি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাই এর পরিষ্কারতা ও গঠন অপরিহার্য।
যদি আপনি চুক্তিপত্রে সঠিকভাবে স্ট্যাম্প বসাতে না পারেন, তাহলে পেশাদার নোটারি পাবলিক বা আইনজীবীর সাহায্য নিন। ভুল স্ট্যাম্প বসানোর চেয়ে সঠিক পদ্ধতিতে, আইন অনুযায়ী চুক্তিপত্র সম্পাদন করাই অধিক নিরাপদ।
চুক্তিপত্র লেখার নিয়মে স্ট্যাম্পের ভূমিকা

একটি চুক্তিপত্রের আইনি বৈধতা নির্ভর করে তার কাঠামো, বিষয়বস্তু এবং ব্যবহৃত স্ট্যাম্পের উপর। অনেকেই ভাবেন চুক্তি মানেই শুধু দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা ও স্বাক্ষর—কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা অনেক বেশি গভীর। আইনের চোখে গ্রহণযোগ্য হতে হলে চুক্তিপত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু কাঠামো মানতে হয় এবং চুক্তিপত্র স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম ঠিকমতো অনুসরণ করতে হয়।
চুক্তির মূল উপাদান এবং স্ট্যাম্পের সম্পর্ক
প্রথমত, একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তিপত্রে যা থাকা উচিত তা হলো—পক্ষের নাম ও ঠিকানা, চুক্তির উদ্দেশ্য, শর্তাবলি, দায়বদ্ধতা, মেয়াদ, নিষ্পত্তির পদ্ধতি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সাক্ষী। এই মৌলিক উপাদানগুলো আইনি গুরুত্ব বহন করে। তবে স্ট্যাম্প ছাড়া এসব তথ্য নিছক এক টুকরো কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে।
স্ট্যাম্প চুক্তিকে সরকারিভাবে স্বীকৃত নথিতে পরিণত করে। এটি চুক্তিপত্রকে আদালতে দাখিলযোগ্য করে তোলে এবং যে কোনো একপক্ষ শর্ত ভঙ্গ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সম্পত্তি, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, ঋণ বা অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ছাড়া চুক্তির কার্যকারিতা প্রায় শূন্য।
স্ট্যাম্প ছাড়া চুক্তিপত্রের ঝুঁকি
স্ট্যাম্পবিহীন দলিল অনেক সময় পক্ষগণ নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসে সম্পাদন করে থাকেন। কিন্তু কোনো সমস্যা বা বিরোধ দেখা দিলে, আদালত সেই দলিলকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য নাও করতে পারে। এ কারণে অনেক সময় চুক্তিপত্র বাতিল হয়ে যায় অথবা পক্ষে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আদালতে দলিলের গুরুত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে একপক্ষ বলে—“আমরা তো লিখিত চুক্তি করেছি”, কিন্তু আদালত প্রথমেই খুঁজে দেখে দলিলে স্ট্যাম্প আছে কি না। যদি না থাকে, তা হলে দলিলকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয় না।
সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (F.A.Q)
প্রশ্ন: স্ট্যাম্প কোথা থেকে সংগ্রহ করা যায়?
উত্তর: স্ট্যাম্প জেলা বা উপজেলা রেজিস্ট্রি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, এবং সরকার অনুমোদিত স্ট্যাম্প বিক্রয় কেন্দ্রে পাওয়া যায়। কিছু বইয়ের দোকানেও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কাগজ বিক্রি হয়।
প্রশ্ন: কোনো সরকারী কাগজ ছাড়া স্থানীয়ভাবে কেনা স্ট্যাম্প কি বৈধ?
উত্তর: যদি স্ট্যাম্প সরকার অনুমোদিত হয় এবং সঠিক মূল্যমান অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়, তবে তা বৈধ। তবে যাচাইযোগ্য সিরিয়াল নম্বর ও সিলমোহর থাকা আবশ্যক।
প্রশ্ন: যদি স্ট্যাম্পে ভুল লেখা হয়, তাহলে করণীয় কী?
উত্তর: গুরুতর ভুল থাকলে সেই স্ট্যাম্প বাতিল করে নতুন স্ট্যাম্প নিতে হবে। কারণ সংশোধিত বা বিকৃত স্ট্যাম্প আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রশ্ন: চুক্তিপত্র জমা দেওয়ার আগে স্ট্যাম্প যাচাই করা কি জরুরি?
উত্তর: অবশ্যই। স্ট্যাম্পের মূল্যের যথার্থতা, বৈধতা এবং মেয়াদ নিশ্চিত করতে হবে। ভুল স্ট্যাম্প ব্যবহার করলে আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
প্রশ্ন: জমি বা সম্পত্তি সংক্রান্ত চুক্তিতে স্ট্যাম্প রেট কি আলাদা হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, সম্পত্তি বা জমির দলিলে স্ট্যাম্প ফি বেশি হয়। এটি সাধারণত আর্থিক মূল্যের ওপর ভিত্তি করে শতকরা হারে নির্ধারিত হয়।
প্রশ্ন: আইনজীবী ছাড়াই কি স্ট্যাম্পযুক্ত চুক্তিপত্র তৈরি করা যায়?
উত্তর: করা যায়, তবে তাতে ভুলের সম্ভাবনা থাকে। সঠিক শর্ত, কাঠামো এবং স্ট্যাম্প ফি নির্ধারণে ভুল হলে দলিল বাতিল হতে পারে। তাই একজন আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া নিরাপদ।
উপসংহার: চুক্তিপত্র স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম মানা কেন গুরুত্বপূর্ণ
চুক্তিপত্র তৈরি মানেই শুধু দুই পক্ষের কথাবার্তা আর স্বাক্ষরের বিষয় নয়—এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আইনি নথি, যার স্বীকৃতি নির্ভর করে সঠিক কাঠামো ও স্ট্যাম্প ব্যবহারের উপর। আপনি যদি একটি দলিল তৈরি করতে চান, তাহলে চুক্তিপত্র স্ট্যাম্প লেখার নিয়ম জানা এবং তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা আপনার জন্য অপরিহার্য।
একটি ভুল স্ট্যাম্প, কম টাকার স্ট্যাম্প, বা সময়োপযোগী না হওয়া স্ট্যাম্প চুক্তিপত্রের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। আবার, অতিরিক্ত স্ট্যাম্প ফি প্রদান করেও আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাই সঠিক রেট জানা, দলিলের ধরন অনুযায়ী স্ট্যাম্প নির্ধারণ করা, এবং যথাযথভাবে তা বসানো—এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করলে আপনি ভবিষ্যতের আইনি ঝুঁকি এড়াতে পারবেন।
চুক্তিপত্র শুধু এখনকার একটি কাজ নয়, এটি ভবিষ্যতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পক্ষের কেউ চুক্তি লঙ্ঘন করলে আদালতে এর ওপর ভিত্তি করেই বিচার হবে। আর যদি সেই দলিলে স্ট্যাম্প সংক্রান্ত ত্রুটি থাকে, তবে তা আপনার পক্ষেই বিপদ ডেকে আনতে পারে।
তাই আপনি যদি জমি কেনাবেচা, ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব, ভাড়া, ঋণ কিংবা কোনো প্রকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, চুক্তিপত্রে সঠিকভাবে স্ট্যাম্প ব্যবহার করুন।

