খালিদ ইবনে ওয়ালিদ : ইসলামের সেবায় সেনাপতি খালিদ ইবনে ওয়ালিদের অবদান ।
The Contribution of Fighter khaled Ibn oyalid Serve in Islam
খালিদ ইবনে ওয়ালিদ বিশ্বের ইতিহাসে অপরাজেয় বীরদের একজন হিসেবে খ্যাত। তিনি মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ এ সেনাপতি ষষ্ঠ হিজরি পর্যন্ত মহানবি (স)-এর ঘাের শত্রু ছিলেন। উহুদ যুদ্ধে (৬২৫ খ্রি.) তিনি কুরাইশদের হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। এ যুদ্ধে মুসলমানরা প্রথম দিকে জিততে থাকলেও শেষ পর্যন্ত খালিদ ইবনে ওয়ালিদের অসাধারণ রণনৈপুণ্যের কাছে পরাজিত হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধি (৬২৮ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হবার পর খালিদ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলামের সেবায় তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। যেমন—
রাসুল (স)-এর সময়:
মুসলিম হওয়ার পর খালিদ ইবনে ওয়ালিদ নিজেকে একনিষ্ঠভাবে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করেন । করেন। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে রােমানদের সাথে সংঘটিত মুতার যুদ্ধে কয়েকজন মুসলিম সেনাপতির মৃত্যুর পর তিনি নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। খালিদ এ যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে বিপর্যয় ঠেকিয়ে মুসলমানদের জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনেন। বিজয়ী খালিদ মদিনায় ফিরে গেলে রাসুলুল্লাহ (স) তাকে সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তরবারি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মক্কা বিজয়ের সময় তার অবিশ্বাস্য বীরত্বে কুরাইশরা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। রাসূল (স) এর আদেশে খালিদ দেবী আল ওজ্জার মন্দির ধ্বংস করেন। তিনি ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে ‘দুমাতুল জন্দলের’ (সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী একটি রাজ্য, বর্তমানে সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত) রাজা উকাইদিরের বিরুদ্ধে সফলতার সাথে একটি অভিযান পরিচালনা করেন । ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিনা রক্তপাতে ইয়েমেন সীমান্তবর্তী নাজরান অঞ্চলের হারিস গােত্রকে ইসলাম
ধর্মে দীক্ষিত করেন।
খলিফা আবু বকর (রা)-এর সময়:
আবু বকর (রা)-এর শাসনকালে (৬৩২-৬৩৪খ্রি.) ভণ্ডনবি ও স্বধর্মত্যাগীদের বিদ্রোহ ইসলাম তথা নবীন মুসলিম রাষ্ট্রকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়। প্রধানত খালিদের অসীম বীরত্বের কারণেই এ বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। ভণ্ডনবি তােলায়হাকে তিনি বুযাখার যুদ্ধে পরাজিত করেন। তার অভিযানের কারণেই আরবের অন্যতম প্রভাবশালী গােত্র বনি তামিমের সব উপগােত্র মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করে। এরপর খালিদ ইয়ামামার যুদ্ধে (৬৩৩ খ্রি.) ভণ্ডনবি মুসায়লামাকে পরাজিত ও নিহত করেন। ঐতিহাসিক ভন ক্রেমার বলেছেন, “খালিদের সাহস এবং আব বকরের (রা) বিজ্ঞতা না থাকলে সেদিন (রিদ্দা যুদ্ধে) ইসলামের শত্রুরা জয়লাভ করত। ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে খালিদ উইলিসের যুদ্ধে পারসিকদের পরাজিত করে হিরা দখল করেন। আবু বকর (রা) তাকে সেখান থেকে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সিরিয়া পাঠান। ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে আজনাদাইনের যুদ্ধে রােমানরা শােচনীয়ভাবে খালিদের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর তিনি দামেস্ক, উরদুন, হিমস্ প্রভৃতি স্থান দখল করেন।
খলিফা ওমর (রা)-এর সময়:
হযরত ওমর (রা)-এর শাসনকালে (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.) ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ইয়ারমুকের যুদ্ধে খালিদ রােমান বাহিনীকে পরাজিত করে সমগ্র সিরিয়া দখল করেন। এ যুদ্ধে সিরিয়ায় রােমানদের চূড়ান্ত পরাজয় হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে খালিদ যে দুঃসাহসিকতা, রণকৌশল ও শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করেন তা অনেক ঐতিহাসিকের কাছে হ্যানিবল, সিজার, নেপােলিয়ন প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বীরদের সাথে তুলনীয় বলে মনে হয় ।
জেনে রাখাে:
হ্যানিবল (Hannibal) (২৪৭-১৮৩/১৮২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ছিলেন একজন কার্থেজ সেনাপতি। তিনি কার্থোজের পিউনিক বংশের লােক ছিলেন। তিনি প্রথম পিউনিক যুদ্ধে একজন নেতৃস্থানীয় কার্থেজীয় সেনাপতি ছিলেন। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে তিনি একটি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আইবেরিয়া থেকে পাইরেনিস হয়ে উত্তর ইতালির আল্পস এলাকায় এ্যালিফ্যান্টের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। হ্যানিবল প্রায় ১৫ বছর ইতালি দখল করে রাখেন। সেনাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন সফল। যুদ্ধের সময় অসাধারণ যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করে তিনি জয় ছিনিয়ে আনতেন।ইতালির জীবনে তিনি ট্রবিয়া ট্রাসেমেনি এবং কানাই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। তবে শেষ জীবনে হ্যানিবল রােমানদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। পরবর্তী সময়ে রােমানরা বিশ্বাসঘাতকতা করলে হ্যানিবল বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
খলিফা ওমর (রা) খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে সিরিয়ার শাসনকর্তা করলে তিনি সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন । সুশাসক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কবি ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। জীবনে কোনাে যুদ্ধেই পরাজিত হননি। খালিদের অসাধারণ বীরত্বের কাহিনি ইসলামের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু তার শেষ জীবন ছিল দুঃখময়। কিছু অভিযােগের কারণে হঠাৎ খলিফা ওমর (রা) তাকে প্রধান সেনাপতি এবং শাসনকর্তার পদ থেকে অপসারণ করেন। পদচ্যুতির কিছুদিন পরে ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান।
পদচ্যুতির কারণ :
যার বাহুবলে মুসলমানরা ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধগুলােতে জয়লাভে সক্ষম হয়েছিল, ওমর (রা)-এর নির্দেশে তার পদচ্যুতি ইসলামের ইতিহাসের এক দুঃখজনক ঘটনা। ঐতিহাসিক ইবনুল আসিরের মতে, হযরত ওমর (রা) খালিদকে নির্দয়ভাবে পদচ্যুত করেন। অন্যান্য ঐতিহাসিকের মতে, ওমরের (রা) কঠোর ন্যায়পরায়ণতা খালিদের পতনের জন্য দায়ী। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তিনি খালিদের মতাে একজন অপরাজেয় বীরকেও ক্ষমা করেননি। তার পদচ্যুতির কারণগুলাে নিচে উল্লেখ করা হলাে:
প্রথমত, খলিফা ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে খালিদের সেনাপতিত্বে পরিচালিত সব যুদ্ধের আয়-ব্যয়ের হিসাব তলব করলে তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে খলিফা অসন্তুষ্ট হন।
দ্বিতীয়ত, অষ্টাদশ হিজরিতে সিরিয়ায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলার সময় খালিদ জনৈক কবিকে তার বীরত্বের গাঁথা রচনার জন্য এক হাজার দিনার পুরস্কার দেন। খলিফা এর জন্য কৈফিয়ত তলব করলেও খালিদ তার জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান। অবশ্য এ পুরস্কার তিনি কবিকে নিজের অর্থ থেকে দিয়েছিলেন।
তৃতীয়ত, গনিমাত হিসেবে তখন তার সম্পত্তির দাম ৬০,০০০ দিনারের বেশি হওয়ার কথা ছিল না। অথচ হিসাব করে দেখা যায়, তার সম্পত্তির মােট মূল্য ৮০,০০০ দিনার। কাজেই খলিফা তার কাছ থেকে ২০,০০০ দিনার মূল্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।
চতুর্থত, খালিদের ঔদ্ধত্য এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি নিষ্ঠুরতা খলিফা ওমর (রা) মােটেই পছন্দ করতেন না।
পঞ্চমত, খালিদ বশ্যতা স্বীকারে আগ্রহী একজনকে হত্যা করায় খলিফা খুবই ক্ষুদ্ধ হন। রিদ্দা যুদ্ধের সময় ইয়ারবু গােত্রের দলপতি মালিক ইবনে নােয়াবার বিদ্রোহী হলে খালিদ তার বিরুদ্ধে অভিযান চালান। মালিক পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি হয়। কিন্তু ভবিষ্যতে সে আবার বিদ্রোহী হতে পারে নিছক এই আশঙ্কায় খালিদ তাকে হত্যা করেন। তিনি মালিকের বিধবা সুন্দরী স্ত্রী লায়লাকে বিয়েও করেন। এতে খলিফা ওমর (রা) খুবই রেগে যান।
সর্বোপরি, খালিদের জনপ্রিয়তা, অপ্রতিহত শৌর্য-বীর্যের জন্য মুসলমানরা তাকে অপরাজেয় ভেবে বিশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা করতে শুরু করে। অনেকে মনে করতে থাকে, রণাঙ্গনে ইসলামের বিজয়গুলাে আল্লাহর অনুগ্রহের চেয়ে বরং খালিদের বাহুবলের জন্যই সম্ভব হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের বিজয় ও গৌরব বৃদ্ধি যে আল্লাহর আনুকুল্যের কারণেই সম্ভব হচ্ছে তা প্রমাণ করার লক্ষ্যেই খলিফা খালিদকে পদচ্যুত করেন।